সোনালি আঁশের জিন আবিষ্কার
দেশ নিয়ে আমরা সব সময় হতাশার খবর শুনি। দারিদ্র্য, জনসংখ্যা, সন্ত্রাসসহ নানাকিছু। কিন্তু গত ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে তার ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি সুখবর দেন- পাটের জিন-নকশা আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ। খবরটি আমাদের জন্য সত্যিই সুখবর। আর এ আবিষ্কারের নায়ক ড. মাকসুদুল আলম। ২০০৮ সালের জুন মাসে শুরু হয়েছিল পাটের জিন-নকশা আবিষ্কারের স্বপ্নযাত্রা। এরপর প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে ৭২ জন বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদের একটি কমিটি গঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে নিজেদের অর্থ ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে কাজ শুরু করেন। পাটের জিন নিয়ে প্রায় দুই কোটি তথ্য তারা সংগ্রহ করেন। এক পর্যায়ে অর্থের অভাবে গবেষণায় বাধা পড়ে। এ খবরটি পৌঁছে যায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কানে। এরপর তিনি নিজ উদ্যোগে মাকসুদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে ৪২ জন গবেষক গবেষণার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তিটি ছিল- যতদিন পর্যন্ত পাটের জিন আবিষ্কার না হয় ততদিন কোন তথ্য কেউ পাচার করতে পারবেন না। প্রত্যেক গবেষক নিয়ম মেনে কাজ করেন। এক পর্যায়ে সফল হলেন তারা।
১৯৭১ সালে শহীদ বাবার আট সন্তানের মধ্যে মাকসুদুল তৃতীয়। গাছপালার প্রতি তার নেশা ছোটবেলা থেকে। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর মা বহু কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। মায়ের পর আমার বড় বোন শামসুন্নাহার আমাদের গড়ে তুলেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে চাকরি পান। তার আয়ের পুরোটাই ভাইবোনদের পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করতেন। আপার কাছে ঋণের শেষ নেই। আমার বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহ দেখে তিনি সব সময় আমাকে উৎসাহ দিতেন। আমি তখন ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ি; বাবা বুড়িগঙ্গার পাড়ে কামরাঙ্গীরচরে এক খণ্ড জমি কেনেন। সেখানে একটি ঘরও তৈরি করেছিলেন তিনি। আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম। নিজের উদ্যোগেই ঘরের এক কোণে একটি গবেষণাগার তৈরি করলাম। বিভিন্ন উদ্ভিদের লতাপাতা এনে একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়ে দেখতাম, কি হয়। প্রাণরসায়ন নিয়ে গবেষণার হাতেখড়ি আমার সেখান থেকেই হয়। জিন-নকশা নিয়ে আমার প্রথম আগ্রহ ঢেঁড়স থেকে। একবার বন্যার পর আব্বা ঢেঁড়স গাছ লাগায় এবং ওই গাছে বেশ বড় সাইজের ঢেঁড়স হয়। তখন আমার মাথায় আসে নিশ্চয়ই পানি, মাটি এবং বীজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রয়েছে। নতুবা আব্বা আগেও ঢেঁড়স লাগিয়েছে কিন্তু সেখানে এত বড় ঢেঁড়স হয়নি।
মাকসুদুল আলমের জন্ম ১৯৫৪ সালে ফরিদপুরে। বাবার বিডিআরে চাকরি সূত্রে ঢাকার পিলখানাতেই তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন। দ্বিতীয় পিএইচডি করেন জার্মানির ম্যাঙ্ প্লানক ইনস্টিটিউট থেকে। অতঃপর তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের প্রধান ফসল পেঁপে। তিনি সেখানে পেঁপের জিন নিয়ে কাজ করেন। তার আবিষ্কৃত নকশা অনুযায়ী হাওয়াইতে পেঁপের উৎপাদন বহুগুণ বেড়েছে। পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে তাদের ফসল। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাঝে তার ডাক আসে মালয়েশিয়া থেকে। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ান সরকার জিন-নকশা নিয়ে একটি গবেষণা কেন্দ্র চালু করে। সেখানে বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন মাকসুদ। ২০০৯ সালের নভেম্বরের মধ্যেই তারা রাবারের জেনোম সিকোয়েন্সিং আবিষ্কার করেন। ২০০৮ সালেই তিনি পাটের জিন-নকশা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান, অধ্যাপক মাহবুব জামান, উদ্ভিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আহমেদ শামসুল ইসলাম, অধ্যাপক আহমেদ আজাদসহ একদল বিজ্ঞানী। এ বিষয়ে অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, ‘অতি সম্প্রতি জুট জিনের একটি খসড়া আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। এটি আমাদের দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার। আমরা চেষ্টা করেছি একটি ভালো কাজ করতে। আমাদের ফলাফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’ পাটের জিন-নকশা আবিষ্কার প্রকল্পে ৪২ জন গবেষকই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বড় ল্যাবরেটরি নেই। গবেষণার পর্যাপ্ত পরিবেশ, অর্থ-সহযোগিতা এখানে পাওয়া যায় না। তারপর এ আবিষ্কার দেশবাসীকে সাহসী করে তুলেছে। ড. মাকসুদ জানান, ‘আমাদের দেশে তরুণরা সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল এখানে গবেষণা করে কী লাভ। অথচ আমাদের সাফল্যের পেছনে তরুণ বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অনেকে ব্যক্তিগত অনেক বিষয় ছাড় দিয়ে নিরলস কাজ করেছেন। আমাদের এক তরুণ সহকর্মীর মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। তিনি তার মা মারা যাওয়ার তিন দিন পর আবার গবেষণায় মনোযোগ দেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীকে। তাদের আন্তরিক সহযোগিতায় আমাদের উদ্যোগ সফল হয়েছে।’ এক সময় পাট ও পাটজাত দ্রব্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী জুটমিল এ দেশের গৌরব। অথচ নারায়ণগঞ্জের আদমজী আজ বন্ধ। বন্ধ খুলনা জুট মিলসহ বেশ কয়েকটি পাটকল। দেশে আদমজীর মতো বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি না করেই সেটি কোনো এক সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। আজ পাটের জি-নকশা আবিষ্কার হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ এর মেধাস্বত্ব নিতে পারবে না। এখন প্রশ্ন একটাই, সোনালি আঁশের জিন-নকশা আবিষ্কার হয়েছে, এর সঠিক বাস্তবায়ন হবে তো!
লেখক: শেখ মেহেদী হাসান
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।