মুক্তা

মুক্তার সাতকাহন

মুক্তা পৃথিবীর প্রাচীনতম মণি। খাঁটি মুক্তা মূল্যবান হওয়ায় তা খুব যত্নে রাখার বস্তুও বটে। কারণ, মুক্তার গঠন কঠিন নয়। খুব সহজেই ক্ষয় হয়ে যায় এটি। ঝিনুক ও শামুক জাতীয় অমেরুদণ্ডী জলজ প্রাণী থেকে তৈরি হয় মুক্তা।

জানা গেছে, কয়েক হাজার বছর আগে প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বে মুক্তার সন্ধান পাওয়া যায়। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপের নানা জাতের আদিবাসীরা তখনও গুহার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে সময় সভ্য মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় প্রথম মুক্তার কদর শুরু হয়। পরবর্তীতে মুক্তার কদর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সর্বত্র। যদিও বহু যুগ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের মুক্তাই ছিল ভুবনবিখ্যাত। বাহরাইনের ছোট্ট দ্বীপ বসেরা, এখানেই পাওয়া যায় ভুবনবিখ্যাত মুক্তা। গড়ন, রঙ এবং মানের দিক থেকে এখানকার মুক্তার সমতুল্য কোনো মুক্তাই নেই। ঝিনুকের পেটে ভোল পাল্টে বালুর কণা রূপ পায় সুডৌল মুক্তার। বহুকাল পর্যন্ত ছোট এই দ্বীপটি পৃথিবীর মধ্যমণি ছিল কেবল মুক্তার কারণেই। কিন্তু যুদ্ধ পাল্টে দেয় মানুষের জীবন, ইতিহাসের পটভূমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুক্তামালার দেশ বসেরা রাতারাতি হয়ে যায় পৃথিবীর অর্থনীতির মেরুদণ্ড পেট্রোলিয়ামের আড়ত। ১৯২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় মুক্তা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০। ১৯৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৬০০। আর এখন শোনা যায়, এ ব্যবসায় গড়তে একজনও নেই। খাঁটি মুক্তার চেয়ে চাষ করা মুক্তায় ছেয়ে গেছে বাজার। তাই তো মুক্তাপ্রেমীর চোখ খুঁজে ফেরে খাঁটি মুক্তা। আর স্বভাবতই প্রকৃত মুক্তার দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্য যে কোনো মণির মতো কয়েকটি মুক্তাও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। যা পেতে বিত্তবানরা উদগ্রীব। এক ইঞ্চি লম্বা ‘লা পেরে গ্রিনা’ এমনই একটি, যা কয়েকশ’ বছর ইউরোপের অভিজাতদের হাত বদল হয়ে ১৯৯৬ সালে ঠিকানা পায় এলিজাবেথ টেইলরের সিন্দুকে। রিচার্ড বার্টন এক বিশেষ মুহূর্তে লিজকে দিয়েছিলেন তার এই ভালোবাসার উপহার। মুদ্রার অংকে সেকালে তার এই ভালোবাসার মাসুল পড়েছিল ৩৭ হাজার ডলার। এ তো গেল মুক্তার ইতিহাস। এবার আসা যাক মুক্তার জন্মকথায়। সাগরের নিচে কুসুম কুসুম গরম বালির বিছানায় বাস করে ঝিনুক। সেখানে খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আবার অনেক সময় নড়াচড়া ও পানির স্রোতে বাইরের কোনো বস্তু, সাধারণত বালিকণা ঢুকে পড়ে ঝিনুকের পেটে। বালিকণা বাইরে বেরুতে না পারায় ঝিনুকের পেটে দানা বাঁধে অস্বস্তি। ঝিনুকের শরীর তখন অস্বস্তি এড়াতে এই বস্তুর চারদিকে ছড়াতে শুরু করে এক ধরনের তরল আঠালো বস্তু। ক্যালসিয়াম কার্বনেটের অতি পাতলা এই স্তর ক্রিস্টালের মতো করে অনুপ্রবেশকারী বস্তুটির গায়ে আস্তরণ ফেলতে শুরু করে। বেশ কয়েক বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এক সময় তা মুক্তায় পরিণত হয়। এতো গেল স্বাভাবিক মুক্তার জন্মের প্রক্রিয়া। আজকাল কৃত্রিম উপায়েও মুক্তা তৈরির প্রচলন বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে মুক্তা চাষিরা মা ঝিনুকের পেটের মধ্যে বালির বদলে ঢুকিয়ে দেন অন্য একটি বস্তু, যা ঝিনুকের শরীরে অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এরপর এগুলোকে রাখা হয় সংরক্ষিত পরিবেশে। সেখানে তার নিজস্ব সময় নিয়ে জন্ম নেয় কৃত্রিম মুক্তা।

১৯২০ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত জাপানে প্রথম মুক্তার চাষ শুরু হয়। জাপানের সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠে মুক্তার সাম্রাজ্য। আর এই সাম্রাজ্য থেকে উৎপন্ন হয় পৃথিবীর ৭৫ ভাগ মুক্তা। প্রথম মুক্তা আবিষ্কার হওয়ায় জাপানকে মুক্তামালার দেশ বলা হয়ে থাকে। জাপান এখন মুক্তা ব্যবসাতেও প্রথম। জাপানের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াও কিন্তু মুক্তার ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ নাম করেছে।

পৃথিবীতে সাদা মুক্তার চাহিদা বেশি হলেও রঙিন মুক্তার আকর্ষণও কম নয়। কৃত্রিমভাবে ইদানীং রঙিন মুক্তার চাষও হচ্ছে। ইদানীং ভারত ও বাংলাদেশে মুক্তার চাষ শুরু হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ গ্রামগঞ্জে ঝিনুক চাষ করা হচ্ছে। কৃত্রিম উপায়ে মুক্তা তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে কৃত্রিম মুক্তার ভিড়ে খাঁটি মুক্তা প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে।

বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি
মুক্তা শৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক। মুক্তা অলংকারে শোভিত অতি মূল্যবান রত্ন। মুক্তার প্রধান ব্যবহার অলংকার হলেও কিছু কিছু জটিল রোগের চিকিৎসায় মুক্তা ও মুক্তাচূর্ণ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, মুক্তা ধারণে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। এ ছাড়া ঝিনুকের খোলস নানা ধরনের অলংকার ও শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি এবং ক্যালসিয়ামের একটি প্রধান উৎস_যা হাঁস, মুরগি, মাছ ও চিংড়ির খাদ্যের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। ঝিনুকের মাংস মাছ ও চিংড়ির উপাদেয় খাদ্য। অনেক দেশে ঝিনুকের মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ একজন চাষি মুক্তা চাষ করে মুক্তার পাশাপাশি ঝিনুকের খোলস ও মাংসল অংশ বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন।

মুক্তা কী
মুক্তা জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভেতর জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরনের রত্ন। কোনো বাইরের বস্তু ঝিনুকের দেহের ভেতর ঢুকে নরম অংশে আটকে গেলে আঘাতের সৃষ্টি হয়। ঝিনুক এ আঘাতের অনুভূতি থেকে উপশম পেতে বাইরে থেকে প্রবেশ করা বস্তুটির চারদিকে এক ধরনের লালা নিঃসরণ করতে থাকে। ক্রমাগত নিঃসৃত এ লালা বস্তুটির চারদিকে জমাট বেঁধে ক্রমান্বয়ে মুক্তায় পরিণত হয়।

মুক্তা চাষের সম্ভাবনা
আমাদের দেশের জলবায়ু মুক্তা চাষ উপযোগী। বাংলাদেশের শীতকাল দীর্ঘ নয় এবং সারা বছরই উষ্ণ আবহাওয়া বিদ্যমান_যা ঝিনুক বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের অনুকূল। আমাদের দেশে বিপুল পরিসরের জলাভূমিতে মাছ চাষের সঙ্গে মুক্তা চাষও সম্ভব। মুক্তা চাষ ব্যয়বহুল কিংবা কঠিন নয়। ঝিনুক চাষে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। জলাশয়ে কেবল নিয়মিত চুন ও সার ব্যবহার করলেই চলে। আমাদের দেশে গ্রামে প্রায় প্রতি বাড়িতে পুকুর কিংবা দিঘি থাকে। সেখানে মুক্তা চাষে গ্রামীণ নারীদের সম্পৃক্ত করা গেলে নারীর ক্ষমতায়নে তা বিশেষ ভূমিকা রাখবে। মুক্তা উৎপাদনকারী অপারেশনকৃত ঝিনুকের বেঁচে থাকার হার ৮৬ শতাংশ এবং মুক্তা তৈরির হার ৯০ শতাংশ।

মুক্তা চাষ সম্পর্কে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মোহসেনা বেগম তনু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মুক্তার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে সাম্প্র্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক গুরুত্বের বিবেচনায় মুক্তা চাষ করা হচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন এবং জাপান অন্যতম মুক্তা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশেও মুক্তা চাষে সাফল্যের সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।