পাট চাষাবাদ

পাট চাষাবাদ

পাট তন্তু জাতীয় উদ্ভিদ। পাটগাছের ছাল থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। আমাদের দেশে পাটকে সোনালি আঁশও বলা হয়। কারণ পাটের আঁশের রঙ সোনালি এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে এ থেকে। পাট থেকে বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন হয়ে থাকে। যেমন- সুতা, থলি, চট, দড়ি, সুতলি। পাট দ্বারা বিভিন্ন প্রকার পর্দা, কার্পেট, জায়নামাজ, ত্রিপল, গালিচা, গদি, শিঁকা, আসন, পাটখড়ি, কাগজ, পারটেক্স, হার্ডবোর্ড তৈরি হয়।

বিশ্বে মোট ১৮.৮৮ লাখ হেক্টর জতিতে পাট চাষ হয় এবং ৩২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন ১ হাজার ৬৫৬ কেজি। পাট উৎপাদনে বিশ্বে এশিয়া মহাদেশই প্রথম। বিশ্বে ৯৫ শতাংশ পাট এশিয়ায় জন্মে। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। কিন্তু মেস্তা জাতীয় পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। ২০০৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮.৩৩ লাখ মেট্রিক টন পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। বিশ্বে এর উৎপাদনের হার ২৬.০২ শতাংশ। এ সময় ৫ লাখ ১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন করা হয়। এবং হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৬২৩ কেজি।

মেস্তা পাট উৎপাদনে ভারত প্রধান। ১৭.৮২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপন্ন হয় ভারতে। বিশ্বের উৎপাদনের ৫৫.৬৮ শতাংশ। ৯.৯০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন হয়। হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদনের পরিমাণ ১ হাজার ৭৫৮ কেজি। ২৫ শতাংশ পাটে আমাদের চাহিদা পূরণের পর ৬০ শতাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং ১৫ শতাংশ ভারতে রফতানি করা হয়। বাংলাদেশে বেশি পাট উৎপাদন করতে গেলে আগে আলোচনায় আসা দরকার। বাংলাদেশে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বিজেআরআই (The Bangladesh Jute Research Institute) ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে পাট উৎপাদনে প্রথম আগমন ঘটান ১৭৯৫ সালে তৎকালীন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচালক Sir William Roxburgh। তার গবেষণার ফল হিসেবে পাট থেকে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের ইতিহাসের সূত্রপাত। পরবর্তী সময়ে কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহার করে ১৮৩২ সালে ইন্ডাস্ট্রি অব ড্যান্ডি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৩ সালে Jhomas Neigh প্রতিষ্ঠা করেন উন্নত ড্যান্ডি ইন্ডাস্ট্রি। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে আজকের এ সোনালি আঁশের বিকাশ ও ব্যবহার পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করছে।

এ পাট বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে। পাটের জাত অনুযায়ী পাট উৎপাদনে জমি, চাষ পদ্ধতি ও সময় উপযোগী জৈব এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়ে থাকে। আমাদের দেশে তোষা ও দেশি দুই ধরনের পাট হয়ে থাকে। এছাড়া অল্প পরিমাণে কেনাফ এবং মেস্তা পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। তোষা পাট প্রধানত উঁচু জমিতে ভালো জন্মে, পক্ষান্তরে দেশি পাট নিচু, মধ্যম ও উঁচু সব প্রকার জমিতে জন্মাতে পারে। উর্বর জমি ছাড়াও যেসব জমিতে খরিফ মৌসুমে বোনা আউশ ধান এবং পাটের ফলন সন্তোষজনক হয় না সেসব জমিতেও কেনাফ এবং মেস্তা ভালো হয়। তবে মেস্তা বেলে মাটির জন্য অধিক উপযোগী এবং কেনাফ নিচু জমিতেও হতে পারে।

তোষা, দেশি, কেনাফ এবং মেস্তার মধ্যে তোষা পাটের আঁশ সবচেয়ে সুক্ষ্ম, মসৃণ এবং শক্ত হয়। পাট থেকে কাপড় ও পাটজাত দ্রব্য তৈরিতে তোষা পাটের উপযোগিতা অধিক বলে এ পাটের দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই তোষা পাটের আবাদ আমাদের দেশে বাড়ছে। পৃথিবীতে ২৯ প্রকার পাটজাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তার মধ্যে তোষাই সর্বোৎকৃষ্ট।

রোপণের সময়ের ওপর ভিত্তি করে তোষা পাটকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। বৈশাখমাসি (১৫ থেকে পরবর্তী সময়) জাত, যথা- ও-৪ এবং ফাল্গুন-চৈত্রমাসি (১০ মার্চ থেকে পরবর্তী সময়) জাত-ও-৯৮৯৭ এবং ওএম-১।

বৈশাখমাসি জাত ও-৪ :
১৯৬৪ সালে আমাদের দেশে প্রথম উদ্ভাবন হয়। সাধারণত বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ পর্যন্ত প্লাবনমুক্ত উঁচু জমিতে এ পাট রোপণ করা হয়। এ পাট গাছের রঙ সম্পূর্ণ সবুজ। পাতা আকষর্ণীয় লম্বা ও চওড়া। এ পাটের আঁশ সব দেশি আঁশের চেয়ে অনেক উন্নত ও দাম অনেক বেশি। সময়মতো রোপণ ও পরিচর্যা করলে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৫১ মেট্রিক টন (একরপ্রতি ৪৯ মণ) পাট উৎপাদন হয়।

ফাল্গুন-চৈত্রমাসি জাত ও-৯৮৯৭:
এ জাতের পাট সাধারণত ফাল্গুন মাসের শেষদিকে ও চৈত্র মাসের প্রথমদিকে রোপণ করা হয়। এ পাট সাধারণ ও-৪-এর মতো হয়, তবে উচ্চতা ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এ পাটের উৎপাদন সবচেয়ে লাভজনক। রোপণের দিন থেকে ১২০ দিনে এ পাট কাটা হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৬১ মেট্রিক টন (একরপ্রতি ৫০ মণ) উৎপন্ন হয়। এ পাটের আঁশ পৃথিবীতে অন্যান্য জাতের পাট অপেক্ষা বেশি উন্নত ও সমাদৃত।

ওএম-১:
ফাল্গুনের শেষ সপ্তাহ থেকে এ পাট বপন করা হয়। এ পাট গাছ সাধারণত লম্বা, সুঠাম এবং দ্রুত বাড়ন্ত। গাছের কা- ঘন সবুজ। পাতার আকার তুলনামূলকভাবে বড় এবং রঙ ঘন সবুজ, মসৃণ ও চকচকে। এর আঁশের রঙ ও মান উন্নত। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৮২ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়।

দেশি পাট : জামিতে বীজ বপন সময়কাল এবং পাট কাটার সময়ের ওপর নির্ভর করে দেশি পাটের জাতকে দুভাগ ভাগ করা হয়েছে।
দেশি আশু বপন উপযোগী জাত।
দেশি নাবি বপন উপযোগী জাত।
দেশি আশু বপন উপযোগী জাত

সিসি-৪৫
এ জাত সাধারণ ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বপনকাল। এ জাতের পাট কেটে রোপা আমন ধান রোপণ করা হয়। এ পাট সাধারণত ৩.০০-৩.৫০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এর কা- সম্পূর্ণ সবুজ। প্রতি হেক্টর জমিতে ৫.১৬ মেট্রিক টন (একরপ্রতি ফলন ৫৬ মণ) উৎপাদন হয়।
বিজেসি-৭৩৭০ (বিজেআরআই দেশি-৫)
চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এর বপনকাল। এ পাট দ্রুত বর্ধনশীল। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৫.৪৬ মেট্রিক টন।
দেশি নাবি বপন উপযোগী জাত

সিভিই-৩
চৈত্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সারা চৈত্র মাস বপন এর আসল সময়। সাধারণত ৩.০০-৩.৫০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পরিণত বয়সে এর মাথায় শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি এবং তামাটে রঙের হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ৪.৫১ মেট্রিক টন।

বিজেসি-৩
চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ পাট বপন করা হয়। গাছের সর্বাংশে সবুজ, পাতা সিডিএল-১ জাতের চেয়ে সরু ও ঢেউ খেলানো। অন্যান্য জাতের চেয়ে এক মাস আগে কাটা হয়। এ জাতের পাট থেকে প্রতি হেক্টরে ৪.৭২ মেট্রিক টন আঁশ পাওয়া যায়।

সিভিএল-১
চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত এ পাট বপনের সময়। এ জাত সাধারণত ১২২-১৩২ দিনে কাটা যায়। সময়মতো বপন ও পরিচর্যা করলে এ জাতের পাট থেকে সর্বোচ্চ ফলন আশা করা যায়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৫.১৬ মেট্রিক টন আঁশ পাওয়া যায়।

কেনাফ
এইচসি-২ সাধারণত ফাল্গুন মাসের শেষ থেকে চৈত্র মাসের মধ্যে এ জাত বপনের আসল সময়। এ জাত সাধারণত ৬.৭০ মিটার লম্বা হয়। উপযুক্ত পরিচর্যায় এর হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৬.৬৩ মেট্রিক টন বা একরপ্রতি ৭২ মণ।

এইচসি-৯৫
এ জাতের পাটের বপন সময় ১ চৈত্র থেকে ১ বৈশাখ। দেশের উত্তরাঞ্চলে এ জাতীয় পাট বেশি উৎপাদন হয়। এর ফলন প্রতি হেক্টর জমিতে ৩.১১ মেট্রিক টন।
ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে এর বপনযোগ্য সময়। সাধারণত বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে এ জাতের পাট উৎপাদন হয়। উপযুক্ত পরিচর্যা ও পরিবেশ পেলে ১৯ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪৭০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়।

রবি ফসল তোলার পরপরই জমি চাষ করা উচিত। যদি চাষ দেয়া না যায়, তবে মৌসুমের প্রথমে বৃষ্টি হলেই জমি চাষ দিতে হবে। পাটের প্রকার ভেদে আড়াআড়ি ৫-৬ বার কিংবা প্রয়োজনবোধে তার চেয়ে কম অথচ গভীরভাবে চাষ করা প্রয়োজন। পাটের বীজ আকারে ছোট তাই জমির মাটি মই দিয়ে মিহি করে আগাছামুক্ত না করলে আশানুরূপ বীজ গজাতে পারে না। বেলে বা দোআঁশ মাটি অপেক্ষা এঁটেল মাটি ভালোভাবে চাষ করতে হয়। যেহেতু কেনাফ ও মেস্তার বীজ আকারে বড় তাই অন্যান্য পাটের মতো এত মিহি চাষের দরকার হয় না।

বীজের হার
দেশি পাট প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১০ (কেজি)।
প্রতি একরে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার কেজি
তোষা পাট প্রতি হেক্টরে ৬ থেকে ৮ কেজি (প্রতি একরে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কেজি)।
কেনাফ প্রতি হেক্টরে ১৪ থেকে ১৯ কেজি (একরপ্রতি ৬ থেকে ৮ কেজি)।
বীজ বপনের পর জমির পরিচর্যা
বপনের এক থেকে দেড় সপ্তাহ পর ‘জো’ অনুযায়ী আঁচড়া দিলে মাটি হালকা হয় ও জমিতে রস সংরক্ষিত হয় এবং অল্প খরচে আগাছাও দমন করা সম্ভব হয়।

গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক অবস্থায় একরপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ চারা থাকা উচিত। বীজ বপনের ৩০-৪০ দিনে সব আগাছা নির্মূল করে সুস্থ ও সবল পাট গাছ রেখে বাকি গাছগুলো জমিতে উর্বরতা ও গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধাপে ধাপে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
জলাবদ্ধতা পাটের ফলন ব্যাহত করে। তাই পাটের জমিতে যেন বর্ষার পানি না দাঁড়ায় কিংবা পানি জমে গেলেও যত যাতাতাড়ি সম্ভব পানি বের করে দিতে হবে।
আগাছা পাটের চারার বড় শত্রু। বপনের পর থেকে যথাসময়ে দুই বা ততোধিকবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা উঠিয়ে ফেলা উচিত এবং আঁচড়া কিংবা ‘হুইল হো’ দিয়ে মাটি আলগা করা প্রয়োজন।

সার ব্যবহারের পরিমাণ এবং পদ্ধতিগুলো:
পাটের জমিতে সঠিক সময়ে পরিমাণমতো সার ব্যবহার করে পাটের ফলন সহজেই বৃদ্ধি করা যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, রাসায়নিক সারের মধ্যে নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) ফলন বৃদ্ধির প্রধান সহায়ক। ফসফরাস ও পটাশ সার (টিএসপি ও এমপি) এককভাবে ব্যবহার করে বেশি ফলন পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ফসফরাস আঁশের গুণগত মান বৃদ্ধি করে ও পটাশ সার গাছের রোগ প্রতিরোধ করে। অন্যদিকে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ একসঙ্গে জমিতে প্রয়োগ করে সাধারণ ফলনের চেয়ে প্রতি হেক্টরে ১ হাজার কেজি অর্থাৎ একরে ৩৭২ কেজির অধিক এবং কোনো কোনো অঞ্চলে আরো বেশি ফলন পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের মাটিতে গন্ধক ও দস্তার অভাব রয়েছে, সেসব জমিতে পরিমাণমতো গন্ধক ও দস্তা সার প্রয়োগ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো এবং বিভিন্ন অঞ্চলের পাটচাষিদের জমিতে পরীক্ষা করে পাট চাষের জন্য সার প্রয়োগের বিধিব্যবস্থা ও সারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও মাটি পরীক্ষা করে সারের পরিমাণ নির্ণয় করাই প্রকৃষ্ট উপায়। কিন্তু যেসব কৃষক মাটি পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা নিম্নলিখিত সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে পারেন। যদি গোবর বা অন্য যে কোনো প্রকার জৈব সার পাওয়া যায় তবে অবশ্যই পাটের জমিতে যথাসম্ভব প্রয়োগ করতে হবে। কারণ জৈব সার মাটির উর্বরতা শক্তি ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া জৈব সারে গাছের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে বলে অন্যান্য রাসায়নিক সার কম লাগে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, কেনাফ, মেসমআ, ও-৪ এবং ও-৯৮৯৭ (ফাল্গুনী তোষা) জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪.৬ টন অর্থাৎ প্রতি একরে ১৮.৬ কুইন্টাল গোবর সার বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ আগে জমিতে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

যদি উপরোক্ত পরিমাণে গোবর সার ব্যবহার করা হয় তাহলে বীজ বপনের দিন ডি-১৫৪, সিডিএল-১, সিসি-৪৫ সিভিই-৩ এবং ও-৪ জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ১৪.৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। টিএসপি এবং এমপি সারের প্রয়োজন নেই। ফাল্গুনী তোষা জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪৯ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি, ১৪ কেজি এমপি; ওএম-১ জাতের জন্য ৩৭.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি; কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য ১৫.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি এবং মেস্তা-২৪ জাতের জন্য ৪ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

গোবর ও অন্যান্য জৈব সারের অভাবে যদি শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়, তাহলে বীজ বপনের দিন ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, ও-৪ জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ৮৩ কেজি জিপসাম, ১৭.৩ কেজি জিংক সালফেট একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ফাল্গুনী তোষা এবং ওএম-১ জাতের জন্য যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমপি এবং ৮৮.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৪০ কেজি এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে উভয় জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৯৭ কেজি জিপসাম ও ১৭.৩ কেজি জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। মেস্তা এইচএস-২৪ এবং কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য যথাক্রমে ৫৫ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি, ৩০ কেজি এমপি এবং ৬৬.৫ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি, ৪০ কেজি এমপি সার মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে গন্ধক (সালফার) ও দস্তা (জিংক) অভাব অনুভব না হলে জিপসাম ও জিংক সালফেট ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। বীজ বপনের সময় জমিতে উপরোল্লিখিত পরিমাপের গোবর ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেও বীজ বপনের ৬-৭ সপ্তাহ পর জমি নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত করে ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, ও-৪ জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ৮৩ কেজি; ফাল্গুনী তোষার জন্য ১০০ কেজি, ওএম-১ জাতের জন্য ৮৮.৫ কেজি, মেস্তা এইচএস-২৪ জাতের জন্য ৫৫ কেজি এবং কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য ৬৬.৫ কেজি ইউরিয়া সার কিছু পরিমাণ শুকনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে হো অথবা নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়বার সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতায় এবং ডগায় না লাগে। আরো লক্ষ্য রাখতে হবে যে দ্বিতীয় কিস্তির সার দেয়ার সময় যেন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকে।

পাট, মেস্তা ও কেনাফের কিছু মারাত্মক রোগ : চারা মোড়ক, ঢলে পড়া, কাওপচা, শুকনো ক্ষত, কালো পট্টি, গোড়াপচা, আগা শুকিয়ে যাওয়া, পাতায় সাদা গুড়া পড়া; এছাড়া ভাইরাসজনিত ১. পাতায় হলদে গুঁড়া পড়া এবং ক্রিমি কীটঘটিত, ২. শিকড়ে গিট রোগ।

পাটের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও তাদের দমন পদ্ধতি
পোকা মাকড়গুলো হলো
১. উড়চুংগা পোকা।
২. বিছা পোকা বা শুয়ো পোকা
৩. ঘোড়া পোকা
৪. কাতরী পোকা।

রোগ ও পোকা দমনের জন্য:
আমরা সাধারণত ৪০ শতাংশ হেক্টাক্লোর পাউডার একরপ্রতি ৪ পাউন্ড অথবা ২০ শতাংশ ডায়েলড্রিন পাউডার ব্যবহার করতে হবে। জোয়াজিনন ৬০ শতাংশ ছমি, নুভাক্রম ৪০ শতাংশ ইসি, ইকালক্স ডো ইসি ব্যবহার করা হয়। তোষা, দেশি ১২০ থেকে ১৩২ দিন পর কেটে এবং কেনাফ ও মেস্তা ৯০ থেকে ১০০ দিন পরপর কেটে পাতা ঝরিয়ে নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে তা পানিতে জাগ দিয়ে পচন দিলে পাটকাঠি থেকে আঁশ ছড়াতে হয়। ওই আঁশ শুকিয়ে চাষিরা বাজারে বিক্রয় করেন। মহাজন শ্রেণী শুকনা পাট ক্রয় করে বি বটম, সি বটম, ডি বটম, শামলা, লালী, কাকটা বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভাগ করে দেশীয় মিলে বিক্রয় বা বিদেশে রফতানি করে।

বাংলাদেশে পাট উৎপাদনে অনেক প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে বিধায় প্রচুর উন্নতমানের পাট উৎপাদন হয়। বর্তমান সরকারকে দেশীয় মিলগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের সহায়তা করে দেশীয় চাহিদা মেটাতে পারে সেই সঙ্গে পাট ও পাটজাত দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে স্বাবলম্বী ও বিশ্বমন্দার কবল থেকে রক্ষা করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। আমরা চাই বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ স্বনির্ভর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব দরবারে দুর্নীতিমুক্ত সবল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করুক এটাই জাতির কাম্য।
প্রতিবেদক: মো. রুস্তম আলী

বিনা চাষে পাট উৎপাদন

একসময় পাট ছিল আমাদের সোনালি আঁশ। মাঝখানে নানান কারণে পাট প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল। কিন্তু পাটের সেই সুদিন আবার ফিরে এসেছে। ফলে পাট চাষে এখন আবারো আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চাষি ভাইয়েরা। কারণ পাটের বাজারমূল্য এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। এই মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় পাট জাগ দেয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিকল্প পাট জাগ দেয়ার জন্য রিবন রেটিংয়ের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কৃষি বিভাগ এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। রিবন রেটিংয়ের সাহায্যে পাট জাগ দেয়ায় পাটের গুণগত মান ভালো থাকে। এ বছর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকার উপসহকারী কৃষি অফিসার আশুতোষ মারফত জানা যায়, এই এলাকায় এ বছর এই পদ্ধতিতে প্রায় ১০০ একর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। চাষিরা জানান, বোরো জমিতেই পাট চাষ করা সম্ভব।

চাষ কৌশল : বোরো ধান কাটার ২০-৩০ দিন আগে ধানের জমিতে জো অবস্খায় অর্থাৎ মাটিতে রস থাকা অবস্খায় বোরো ধানের জমিতে পাট বীজ বুনে দিতে হয়। মাটিতে রসের অভাব হলে একটা সেচ দিয়ে নিতে হবে। কিছু দিনের মধ্যে পাটবীজ গজাবে।

বীজের পরিমাণ : প্রতি বিঘা জমিতে (৩৩ শতাংশ) ১০০০ গ্রাম-১২৫০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন।

জাতের নাম : তোষা পাটবীজ।

সারের পরিমাণ : কোনো সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। বোরো চাষের সময় যে পরিমাণ সার ব্যবহার করা হয়েছে ওই ফসল তোলার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তাতেই পাট উৎপাদন করা সম্ভব।

পরিচর্যা : বোরো ধান কাটার পর পাটের জমিতে দুইবার নিড়ানি দিতে হবে। এতে করে আগাছা দমন হবে এবং মাটির আস্তরণ ভাঙার ফলে মাটির রস সংরক্ষিত হবে।

ফলন : এই পদ্ধতিতে চাষ করে ১০-১২ মণ বিঘাপ্রতি (কাঁচা পাটের আঁশ) ফলন পেয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় চাষ দিয়ে চাষিরা পাট উৎপাদনে ফলন ৭-১০ মণ প্রতি বিঘায় পেয়েছেন। বিষয়টি অনেকের কাছে লাভজনক বলে মনে হয়েছে।

লেখক: অসিত কুমার সাহা, কৃষিবিদ
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।