চাহিদানুযায়ী মাছের খাদ্য তালিকা
বর্তমানে নানা কারণে মাছচাষিদের দুঃসময় চলছে। গত ২ থেকে ৩ বছর সফল ও লাভজনকভাবে খামার পরিচালনা করছেন এমন চাষির সংখ্যা খুব কম। মাছ চাষে গড়ে ৭৫ ভাগ খরচ হয় খাদ্য বাবদ। আর সেজন্য খামার লাভজনকভাবে পরিচালনা করতে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাধারণত মাছ চাষিরা মাছের খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুকুরের মাছের মোট দৈহিক ওজনের শতকরা হারে খাদ্য প্রয়োগ করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা হচ্ছে- ৪০ শতাংশের একটি পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৫০টি ঘনত্বে যদি প্রতিটি ১০০ গ্রাম ওজনের ৬০০০টি পাঙ্গাস মাছ থাকে তাহলে মাছের মোট দৈহিক ওজন হবে ১০০ গ্রাম দ্ধ ৬০০০ = ৬০০ কেজি। ৫% হারে খাদ্য প্রয়োগ করলে দৈনিক ৩০ কেজি খাদ্য উক্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে ১০০ গ্রাম ওজনের মাছটির দৈনিক খাদ্য চাহিদা কত গ্রাম বা দৈনিক বৃদ্ধি কত গ্রাম তা না জেনেই খাদ্য প্রয়োগ করছেন। মাছ চাষিরা এ পদ্ধতিতে খাদ্য প্রয়োগ করে ১০ থেকে ১৫% অপচয় হলেও এক সময় লাভের পরিমাণ বেশি হওয়াতে তা চোখে পড়েনি। বর্তমানে লাভ অত্যন্ত সীমিত হওয়ায় অপচয় রোধের ব্যাপারে মাছ চাষিদের সচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে আরো বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাছের খাদ্য প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে, যে পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ চাষিরা উপকার পেতে পারেন-
১) খাদ্যের অপচয় কমানো;
২) খাদ্যের পচনজনিত কারণে পানির গুণগত মান নষ্ট না হওয়া;
৩) দৈহিক ওজন ও দৈনিক বৃদ্ধি সম্পর্কে অবগত থাকা ও খাদ্যের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা;
৪) মাছের মৃত্যুহার কম হওয়া;
৫) মাছের উত্পাদন খরচ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা ও লাভ নিশ্চিত করা।
এক্ষেত্রে দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত পাঙ্গাস চাষের পুকুরে দৈনিক প্রতিটি মাছের মাথাপিছু কত গ্রাম খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে তার তালিকা- ৫০ থেকে ৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৩ গ্রাম, চাষকাল ৩৩ দিন। ১০০ থেকে ১৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ২ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৪ গ্রাম, চাষকাল ৫০ দিন। ২০০ থেকে ২৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৩ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৬ গ্রাম, চাষকাল ৩৩ দিন। ৩০০ থেকে ৩৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৪ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৮ গ্রাম, চাষকাল ২৫ দিন। ৪০০ থেকে ৪৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১০ গ্রাম, চাষকাল ২০ দিন। ৫০০ থেকে ৫৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৬ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১২ গ্রাম, চাষকাল ১৭ দিন। ৬০০ থেকে ৬৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৭ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৪ গ্রাম, চাষকাল ১৪ দিন। ৭০০ থেকে ৭৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৭.৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৫ গ্রাম, চাষকাল ১৩ দিন। ৮০০ থেকে ৮৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৮ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৬ গ্রাম, চাষকাল ১১ দিন ও ৯০০ থেকে ১০০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৯ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৮ গ্রাম, চাষকাল ১০ দিন।
এভাবে একটি পাঙ্গাস চাষের পুকুরে ৫০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজন হতে ২২৫ দিন/৭ মাস ১৫দিন চাষকাল লাগতে পারে। ২২৫ দিন চাষকাল শুধু পূর্ণমাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ কালকে হিসাব করা হয়েছে। শীতকালে খাদ্য বিরতির সময় হিসাবে আসবে না। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে পোনার গুণগত মান, চাষির দক্ষতা ও খামার ব্যবস্থাপনার মানের উপর ফলাফল এর চাইতে কিছুটা ভালমন্দ হতে পারে।
উল্লেখিত ফলাফল পেতে শর্তসমূহ:
১) পাঙ্গাসের একক চাষ হতে হবে;
২) খাদ্যে আমিষের পরিমাণ ২৬ থেকে ২৮% হতে হবে ও সুষম খাদ্য হতে হবে;
৩) পানির গুণগত মান ও পরিমাণ ঠিক থাকতে হবে;
৪) পানির তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৬ ডি:সে: থাকতে হবে।
মাছ চাষে যে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে তা হচ্ছে FCR (Food Conversion Rate) বা খাদ্য রূপান্তর হার কত। খাদ্য রূপান্তর হার যদি ২ (২কেজি খাদ্য=১ কেজি মাছ) এর অধিক হয় তাহলে উত্পাদন লাভজনক হয় না। সে হিসাবে মাছের খাদ্য অবশ্যই চাহিদা অনুযায়ী দেয়া উচিত; অনুমান নির্ভর কোনো পদ্ধতিতে নয়। উপরের গ্রোথ চার্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি পাঙ্গাস মাছের দৈনিক খাদ্যের চাহিদা অনুযায়ী ৬০০০ মাছের পুকুরটিতে দৈনিক মোট ২৪ কেজি খাদ্যই যথেষ্ট। এর অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ করলে অপচয় হতে পারে যার ফলে পানির গুণগতমান দ্রুত নষ্ট হয় যা নানা ধরনের রোগ ও মৃত্যু হার বেড়ে যাওয়ার কারণ।
তেলাপিয়া চাষিদের সুবিধার্থে তেলাপিয়া মাছের দৈনিক মাথাপিছু গ্রাম হিসাবে খাদ্য প্রয়োগের তালিকা- ১০ থেকে ৫০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.২৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ২.৫ গ্রাম, চাষকাল ৩২ দিন। ৫১ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.৭৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৩.৫ গ্রাম, চাষকাল ২৮ দিন। ১০১ থেকে ১৫০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ২.২৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৪.৫ গ্রাম, চাষকাল ২২ দিন। ১৫১ থেকে ২০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ২.৭৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৫.৫ গ্রাম, চাষকাল ১৮ দিন। ২০১ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৩.২৫ গ্রাম দৈনিক খাদ্যের চাহিদা ৬.৫ গ্রাম, চাষকাল ১৬ দিন। ২৫১ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৩.৭৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৭.৫ গ্রাম, চাষকাল ১৩ দিন। এভাবে চাষের পুকুরে তেলাপিয়া মাছ ১২০ থেকে ১৪০ দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজন হতে পারে।
তেলাপিয়া মাছের চাষে মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ অধিক লাভজনক। এক্ষেত্রে চাষিকে সতর্ক থাকতে হবে মানসম্পন্ন পোনার ব্যপারে। দেড় থেকে দুই মাস নার্সিং করার পর প্রতিটি ১০ গ্রাম ওজনের মাছ প্রতি শতাংশে ২৫০টি পর্যন্ত চাষ দেয়া যেতে পারে। নার্সারি খাদ্যে ৩৩ থেকে ৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ গুঁড়া খাবার সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেহেতু প্রথমদিকে খাদ্য চাহিদা ছোট পোনা মাছের দৈহিক ওজনের প্রায় সমান সে জন্য শুরুর দিকে দৈহিক ওজনের ১০০% দুই সপ্তাহ এবং পরবর্তী প্রতি সপ্তাহে ৩৫%, ২৫%, ১৫%, ১০% এভাবে কমাতে হবে। উল্লেখ্য যে এ হারে খাদ্য প্রয়োগ কমাতে থাকলে মাছের ওজন বৃদ্ধির ফলে দৈনিক মোট খাদ্যের পরিমাণ কমবে না বরং বাড়বে। এভাবে দেড় থেকে দুই মাস পর মাছের ওজন ১০ গ্রাম হয়ে গেলে মাছ চাষের পুকুরে মজুদ করতে হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। মাছের খাদ্যের চাহিদা প্রতিনিয়তই বাড়তে থাকে সে জন্য প্রতি ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর মাছের গড় ওজন পরীক্ষা করে খাদ্যের চাহিদা ও পরিমাণ ঠিক করতে হবে ও পর্যায়ক্রমে বাড়াতে হবে।
উল্লেখিত তালিকা অনুযায়ী খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে চাষিকে দৈনিক গড়ে মাছপ্রতি কত গ্রাম খাদ্য চাহিদা হচ্ছে তা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ৫০ থেকে ৯৯ গ্রাম ওজনের পাঙ্গাস মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.৫ গ্রাম আর দৈনিক খাদ্যের চাহিদা ৩ গ্রাম। এক্ষেত্রে মাছের ওজন যখন ৫০ গ্রাম তখন দৈনিক খাদ্য চাহিদা ২ গ্রাম হতে পারে আবার মাছটি ৯০ থেকে ৯৫ গ্রাম ওজন হলে দৈনিক খাদ্য চাহিদা ৩ থেকে ৩.৫ গ্রাম হতে পারে। নিয়মিত ওজন পরীক্ষার মাধ্যমে চাষিকে খাদ্য চাহিদা নিরুপণ করতে হবে। দৈনিক বৃদ্ধি হার যদি গড়ে ২ গ্রাম পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খাদ্য চাহিদা হবে ৪ গ্রাম। আশা করি মাছ চাষি ভাইরা উত্পাদন খরচ কমিয়ে লাভজনকভাবে খামার পরিচালনা করতে লেখাটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
লেখক: মো. মোজাম্মেল কবির, মাছচাষি, আকুয়া চৌরঙ্গী মোড়, ময়মনসিংহ
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।