পাংগাস মাছ

পাংগাস মাছের লাভজনক মিশ্র চাষ

ভূমিকা
দেশে থাই পাংগাসের আমদানি এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটায় মাছ চাষে বৈপ¬বিক পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু পুকুর-দিঘীর ইজারা মূল্যসহ চাষের উপকরণের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির ফলে চাষিরা আর আগের মতো লাভবান না হতে পেরে অনেকটা দিকভ্রষ্ট হয়ে বিকল্প লাভজনক মাছচাষ পদ্ধতি খুঁজতে থাকেন। একদিকে পাংগাসের সহজ চাষ ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন মাত্রা অধিক হলেও পাংগাস চাষে লাভ না থাকলেও চাষি এ মাছ চাষ পরিত্যাগ করতে আগ্রহী নন। অপর দিকে, দেশীয় কার্প জাতীয় মাছের স্বল্প উৎপাদন হার এবং একক আয়তনের জলাশয়ে অধিক লাভের প্রবণতা চাষিকে মাছ চাষের নানা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করে। সমাধানের উপায় হিসেবে বাণিজ্যিক মাছ চাষিগণ থাই পাংগাসের সাথে নানা প্রজাতির মাছ সাথি ফসল হিসেবে কিভাবে লাভজনকভাবে চাষ করা যায় তার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। পাংগাস মাছের সাথে তেলাপিয়া, কৈ, গলদা চিংড়ি এবং শিং-মাগুর প্রভৃতি মাছচাষ করা হচ্ছে বিগত কয়েক বছর যাবত। নানা বিকল্প মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে বিশেষ করে ব্যাপকভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা অঞ্চলে অত্যন্ত সফলতার সাথে পাংগাস মাছের সাথে তেলাপিয়া (মনোসেক্স) এবং শিং মাছ একত্রে চাষ করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। এ পদ্ধতিতে একক আয়তনের জলাশয়ে মাছের উৎপাদন এবং আর্থিক লাভও অনেক বেশি। এখানে লক্ষণীয় যে, উলি¬খিত তিনটি প্রজাতির মাছ এককভাবে চাষযোগ্য তবে এদের একক চাষের তুলনায় মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ অনেক বেশি লাভজনক। জলাশয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি জলাশয়ের তলদেশের পরিবেশ জৈবিক উপায়ে সংরক্ষিত হওয়ায় এ পদ্ধতি বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ এবং মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য লাভজনকভাবে এ মাছচাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।

পাংগাস মাছ

চাষের জন্য স্থান নির্বাচন
বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য আলোচ্য মাছচাষ কল্পে ধান ক্ষেতকে স্বল্প গভীরতায় বেড়ী বাঁধ দিয়ে ঘেরে (Paddy Land Temporarily Converted to Low Depth Pond) পরিণত করা জলাশয় বেশ উপযোগী। তবে যে সকল জলাশয় সহজে শুকানো যায়, প্রয়োজনমত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, উৎপাদিত মাছ ও খাদ্য উপকরণ সহজে পুকুর পাড়ে পরিবহন করার মতো যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে এবং সর্বোপরি পর্যাপ্ত সূর্যের আলো দীর্ঘ সময় পুকুরে পড়ে এরূপ পুকুর নির্বাচন করতে হবে। উপযুক্ততা বিবেচনা না করে যে কোনো পুকুরে এ ধরনের অগ্রসর পদ্ধতির মাছ চাষ করতে গেলে সফলতা পাওয়া কঠিন হয়।

পুকুর প্রস্তুতি
চাষের পুকুর অবশ্যই ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুর শুকানোর পর চুন প্রয়োগ করতে হবে শতকে এক কেজি হারে। পুকুরের তলদেশে যদি কাদা থেকে যায়, তবে চুন কাদার সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পুকুরে যদি ইতোপূর্বে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা হয়ে থাকে তবে চুনের পাশাপাশি শতকে ৫০০ গ্রাম হারে পটাশ সার (Murate of Potash) দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা এক মিটার হওয়া উত্তম। পুকুরে কোনো প্রকার জৈব সার দেয়া যাবে না।

পোনা মজুদ
পোনা মজুদের জন্য পরিচিত মৎস্য খামার থেকে ভালোমানের পাংগাস (১৮-২০ সেমি), তেলাপিয়া (৬-৮ সেমি) এবং শিং মাছের (৭-৮ সেমি) পোনা সংগ্রহ করতে হবে। সাথে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়তে হবে ১৪-১৬ সেমি আকারের। এ আকারের পোনা পাওয়া নিশ্চিত করা এবং চাষে অধিক লাভবান হবার জন্য ধানি পোনা সংগ্রহ করে নিজস্ব পুকুরে উপযুক্ত আকার পর্যন্ত বড় করে নিতে হবে। চাষের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে ভালোমানের উপযুক্ত আকারের পোনার ওপর। একটি এক একর পুকুরে পোনা ছাড়ার পরিমাণ নিম্নে দেয়া হলো:
পাংগাস মাছ
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
মাছের খাদ্য প্রদানের মূল নীতি হলো, মাছ যে পরিমাণ খাবার খেতে পারে ঠিক সেই পরিমাণ খাদ্য প্রতিদিন সময়মত নির্ধারিত স্থানে প্রদান করা। সে উদ্দেশ্যে পোনা ছাড়ার পর হতে নিয়মিতভাবে দিনে দুবার মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ১০-৩ ভাগ হারে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্যে আমিষের ভাগ ৩০% হতে হবে। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বাণিজ্যিক খাবার (Pillet Feed) এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন মাছ সবটুকু খাবার খেয়ে ফেলে। কারণ অভুক্ত খাদ্য পচে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্যের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ফিড ট্রে (Feeding Tray) পদ্ধতি উত্তম। এক একর পুকুরে ১ মি. × ১ মি. মাপের ২০টি ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ট্রেসমূহ পানি থেকে ০.৫ মি. গভীরতায় ঝুলিয়ে দিতে হবে। বাঁশের চাটাই দ্বারা মাচা (Platform) তৈরি করেও তার উপর খাবার দেয়া যেতে পারে। খাবার দেবার ১ ঘন্টা পরে ফিড ট্রে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে মাছ সব খাবার খাচ্ছে কি না। সব খাবার গ্রহণ না করলে খাদ্য প্রদান অবশ্যই কমিয়ে দিতে হবে।

মাছের নমুনাকরণ এবং খাদ্য সমন্বয়
বাণিজ্যিক মাছ চাষের পুকুরে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ চাষ করার প্রতি ১২-১৫ দিন পরপর কাস্ট নেট দিয়ে ছোট অবস্থায় বেশি এবং বড় হলে কমপক্ষে ৫০টি মাছ ধরে গড় ওজনের মাধ্যমে মোট মাছের ওজন (Biomass) হিসাব করতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে খাদ্য প্রয়োগের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। তবে কমাবার হার বা খাদ্য প্রয়োগের হার প্রকৃতপক্ষে মাছের খাদ্য গ্রহণ এবং পানির পরিবেশের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। পানির রং ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আবার নতুন তৈরি জলাশয়ে যে পরিমাণ খাদ্য মাছকে দেয়া যায় পুরাতন পুকুরে সে পরিমাণ খাদ্য দেয়া যায় না অর্থাৎ পুরাতন পুকুরের পানি দ্রুত সবুজ হয়ে আসে। ফলে, খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হয়। খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (Food Conversion Ratio) অধিক হলে জলাশয়ের পরিবেশ ভালো থাকে বিধায় ভালো মানের খাদ্য কম হারে প্রয়োগ করে মাছের বেশি বর্ধন পাওয়া যায়। আবার যে সব পুকুরে নিয়মিত পানি পরিবর্তন করা হয় সে সব পুকুরের মাছ বেশি খাদ্য খায়। ফলে এক্ষেত্রে খাদ্য বেশি দিতে হয়। এক কথায় মাছকে যত বেশি খাবার খাওয়ানো যাবে মাছের বর্ধন তত দ্রুত হবে এবং মাছের উৎপাদনও বেশি পাওয়া যাবে।

অন্যান্য পরিচর্যা
পুকুর/ঘেরের পানির পরিবেশ ভালো রাখার জন্য (অবস্থা বুঝে) ঘেরের পানি আংশিক পরিবর্তন করতে হবে এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর শতকে ২৫০ গ্রাম হারে চুন ও খাদ্য লবণ একত্রে বা পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়াও অবস্থা বুঝে শতকে ২৫০ গ্রাম হারে পটাশ সারও প্রয়োগ করতে হতে পারে। এ সকল পদক্ষেপ ছাড়াও ঘেরের তলদেশে জমে থাকা ক্ষতিকর গ্যাস অপসারণের জন্য ২-৩ দিন পর পর দুপুরের সময় পানিতে নেমে অথবা হররা টেনে পানির তলদেশ আলোড়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে গ্যাস সৃষ্টির প্রধান কারণ খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ জমা হওয়া। খাদ্য প্রয়োগের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য কোনো ভাবেই প্রয়োগ করা না হয়। মাছ চাষে পুকুরের পানি অধিক সবুজ, পুকুরের তলদেশে ক্ষতিকর গ্যাস সৃষ্টি হওয়া ও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিলে অনেক সময় কিছু মাছ মারাও যেতে পারে। পুকুরের সার্বিক পরিবেশ ভালো রাখার জন্য জিওলাইট, একুয়াম্যাজিক এবং ক্ষতিকর গ্যাস হতে মাছ রক্ষার জন্য গ্যাসনেক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। অক্সিজেনের অভাব হলে পুকুরে পানি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানি অধিক সবুজ হয়ে গেলে পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে। তুতে বা অন্যান্য কিছু রাসায়নিক দ্রব্য (Blue Lagoon) ব্যবহার করে সাময়িকভাবে সবুজভাব (Phytoplankton) দূর করা গেলেও তা ক্ষণস্থায়ী হয়। পুকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ থাকলে খাবার দিলে মাছ পানির উপরের স্তরে চলে আসে বিধায় শিকারী পাখি দ্বারা মাছ ধরে নেবার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পুকুরের উপর নেট দ্বারা আবৃত করে দেয়া যেতে পারে। এভাবে ৮-৯ মাস চাষের পর পাংগাস মাছ গড়ে প্রায় ১০০০-১১০০ গ্রাম ওজনের হয়। এসময় পাংগাস মাছসহ অন্যান্য মাছ বাজারে পাঠানোর উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

মাছ বাজারজাতকরণ
তেলাপিয়া ও শিং মাছের বাজার দর সকল সময়ই ভালো থাকে। তবে সার্বিকভাবে বাজারের অবস্থা বুঝে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট বাজারের থেকে দেশের বড় বাজারসমূহে বড় আকারের মাছের চাহিদা বেশি থাকে। শিং এবং পাংগাস মাছ জীবিতাবস্থায় বাজারজাতকরণের জন্য পস্টিক ড্রামে করে মাছ বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
পাংগাস মাছ
এক একর একটি পুকুরে মাছ উৎপাদনের আয় ও ব্যয়ের হিসাব (*টাকার হিসেব সমূহ সমসাময়িক সময়ের হিসাবে সম্বনয় করে নিতে
প্রতিবেদক: মোঃ তোফাজউদ্দীন আহমেদ
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।

1 reply

Trackbacks & Pingbacks

  1. […] থাকতে হবে। যেমন, ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি পাঙ্গাশ মাছের দৈনিক বৃদ্ধি ৬ গ্রামের ওপরে […]

Comments are closed.