তিতির পাখি

তিতির পালনে করনীয়

দেখতে অনেকটা মুরগির মতো হলেও তিতির আসলে পাখি। পৃথিবীতে পোল্ট্রির যে ১১টি জাত আছে তার মধ্যে তিতির একটি জাত। তবে গ্রামাঞ্চলে একে চায়না বা চীনা মুরগি বলা হয়। তিতির এর ইংরেজি নাম Guinea Fowl । তিতির পাখির বাজার মূল্য দেশি হাঁস-মুরগির চেয়ে অনেক বেশি। তাই এটি পালন দেশি মুরগির চেয়েও লাভজনক। ফলে তিতির পাখি পালন দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করতে পারে।

জাতঃ

পালকের রং এর ভিত্তিতে এই পাখিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-
১) পার্ল ভ্যারাইটি- এদের সাধারনত ধুসর পালক থাকে। পালকে ফোটা ফোটা সাদা দাগ থাকে। দেখতে খুব আকর্ষণীয়।
২) লেভেনডার ভ্যারাইটি- পালকের বৈশিষ্টের দিক থেকে পার্ল ভ্যারাইটির সঙ্গে মিল রয়েছে। ভিন্নতা শুধু পালকের রং হালকা ধূসর।
৩) সাদা ভ্যারাইটি- এটির পালক সাদা এবং এর পালকে কোন দাগ নেই।
বি.দ্র: তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে মিল রেখে পার্ল ভ্যারাইটি জাতটি পালন করা সহজ ।

পুরুষ ও স্ত্রী তিতির চেনার উপায়:

পুরুষ তিতির:
১. হেলমেট সুউচ্চ ও মাথার মাঝখানে থাকে।
২. ওয়াটলস্ বেশ বড় হয়।
স্ত্রী তিতির:
১. হেলমেট তুলনামূলক ছোট ও মাথার সামনের দিকে থাকে।
২. ওয়াটলস্ বেশ ছোট হয়।

তিতির পালনের সুবিধা ও অসুবিধা:

তিতিরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। প্রাকৃতিক খাদ্য খায় বলে খাদ্য খরচ কম। উন্নতমানের ঘর দরকার হয় না। খুব বেশি জিনিসপত্র লাগে না। ডিম ভাঙার সম্ভাবনা কম থাকে। তিতির পালনে খরচ ও ঝুঁকি অনেক কম । এরা পরিবেশের সাথে অনেক সংবেদনশীল । তাই বাড়িতে তিতির পালন করা খুব সহজ।

অসুবিধার মধ্যে তিতিরের বাচ্চার মৃত্যুর হার খুব বেশি। মা বাচ্চার যত্ন নেয় না। ছাড়া পালন করলে বনে ডিম পাড়ে বা ডিম লুকিয়ে রাখে। এরা ঝোপঝাড়, জঙ্গল পছন্দ করে বলে শিয়াল, কুকুর, চিল, বাজপাখি, বেজি, সজারু ইত্যাদি প্রাণী এদের ধরে খায়। লিটারে পালনের ক্ষেত্রে বাচ্চাগুলো লিটারের ময়লা খায়। ফলে পেটে সমস্যা হয়। তিতির খাচায় পালন করলে এগ্রেসিভ হয়ে যায় এবং ঠোকরা ঠুকরি করে।

তিতিরের খাদ্য:

এদের খাবারের পছন্দের তালিকায়, কচি ঘাস, ঘাসের বিচি, পোকা মাকড়, কখনো মাটি, ধান, গম, ভুট্টা ভাংগা, ধানের কুড়া, ভাত ইত্যাদি। আবদ্ধ ও অর্ধমুক্ত পালনের জন্য ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির ক্রয় করা খাদ্য বা ফিডার খাওয়াতে হয়। দৈনিক ১১৮-১২১ গ্রাম খাদ্য খায়।

তিতির পালন পদ্ধতিঃ

১. মুক্ত পদ্ধতি (Free range)
২. আধা-মুক্ত (Semi-intensive) পদ্ধতি
৩. বদ্ধ (cages & deep litter) পদ্ধতি
এছাড়া বাড়িতে হাঁস মুরগীর সাথে অনায়াসে তিতির পালন করা যায়।

মুরগীর বাচ্চার তুলনায় তিতিরের বাচ্চা ঠাণ্ডায় অধিক সংবেদনশীল। সেজন্য প্রথম সপ্তাহে উচ্চ ব্রুডিং তাপমাত্রা প্রয়োজন। তাছাড়া খেয়াল রাখবেন তিতির খুব অলস জাতের পাখি । এরা নিজেদের ডিম খুব বেশী একটা উম দেয় না । কিংবা দেখা যায় যদি উম দেয় তবে দুই একটি বাচ্চা ফুটলে এরা উঠে চলে যায় । তাই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ব্যপারে বেশ সতর্ক হতে হবে ।
১ম থেকে ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৭ ডিগ্রি সেঃ এবং ৪র্থ থেকে ৫ম সপ্তাহ ৩৬ ডিগ্রি সেঃ এ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে হবে। আর জায়গার ক্ষেত্রে ১ থেকে ৪ সপ্তাহের একটা তিতিরের বাচ্চার জন্য ০.৫ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। ৫ থেকে ৮ সপ্তাহের তিতিরের জন্য ১.০ বর্গফুট জায়গা লাগে। ৯ থেকে ১৩ সপ্তাহের তিতিরের জন্য ১.৫ বর্গফুট জায়গা লাগে। আর পূর্ণ বয়স্ক তিতিরের জন্য লাগে ২ থেকে ২.৫ বর্গফুট জায়গা।

আবদ্ধ অবস্থায় তিতির পালনের জন্য ঘর নির্মাণ করতে হয়। তিতিরের ঘর বাঁশ, বেত, কাঠ, টিন, ছন, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা যায়। ২-৩ ফুট ওয়াল করে ওপরে নেট দিয়ে টিনের চালের ঘর তৈরি করলে দীর্ঘদিন টেকসই হয়। ঘর আলো বাতাস পূর্ণ স্থানে করতে হয়। ঘর প্রতিদিন পরিষ্কার রাখতে হয়। স্যাঁতসেতে যাতে না হয়। তিতিরের পায়খানা ঘরের মেঝেতে যেন লেপ্টে না যায় সেজন্য ঘরের মেঝেতে ধানের তুষ, করাতের গুঁড়া ছিটিয়ে দিতে হবে । এছাড়াও যদি তিতিরের পায়খানা জমতে জমতে শক্ত জমাট বেঁধে গেলে বারবার তা উলট-পালট করে দিতে হবে ।

তিতিরের রোগ-বালাই,ভ্যাকসিন ও তার প্রতিকার:

বাড়িতে তিতির পালন করার ক্ষেত্রে তিতিরের কয়েকটি রোগ বালাই দেখা যায়। তিতিরের মারাত্নক কয়েকটি রোগ উকুন, গোলকৃমি, রক্তআমাশয়, ট্রাইকোমোনিয়াসিস ইত্যাদি। এই সকল রোগের ব্যাপারে অবশ্যই টিকা দিতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে মুরগির রানীক্ষেত রোগ হয় তাই বিশেষ সতর্কতার জন্য তিতিরকে রানীক্ষেত রোগের টিকা দিতে হবে। সতর্কতা হিসেবে কোন অবস্থায় রোগাক্রান্ত পাখিকে টিকা দেয়া যাবে না।

Splayed legs (খোঁড়া পা): হ্যাচারী থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর পরই এ রোগটি keets (তিতির পাখির বাচ্চা) এ দেখা যায়। তিতিরের অসুস্থ্য বাচ্চাগুলি এলোমেলো ভংগিতে হাটতে থাকে। পা আলতোভাবে চিকন পাইপ দিয়ে আটকে দিলে বাচ্চগুলি ভালো হয়ে যায়।

Coccidiosis (রক্ত আমাশয়): Coccidiosis একটি সাধারণ প্যারাসিটিক রোগ যা ডায়াজেসটিব ট্র্যাক্টকে প্রভাবিত করে। রক্ত মিশ্রিত আঠালো সাদা ডায়রিয়া থাকতে পারে। Coccidiosis একটি প্রোটোজোয়ান প্যারাসাইট (coccidia) দ্বারা সৃষ্ট হয়। গিনি ফাউলের খাবার পানিতে ড্রুপিংস পাওয়া যেতে পারে যা থেকে দ্রুত Coccidiosis ছড়িয়ে পড়ে।

তবে যদি কোন তিতির অসুস্থ্য হয় তাহলে উক্ত তিতিরকে যথাশীঘ্রই অন্যান্য তিতির থেকে সরিয়ে নিতে হবে। অসুস্থ্য তিতিরের সংস্পর্শে থাকলে বাকি সুস্থ তিতিরও আক্রান্ত হতে পারে। আর বেশী সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

দেশি মুরগি যেখানে ৬ মাসে সর্বোচ্চ ১ কেজি ওজনের হয়, সেখানে তিতির পাখি দেড় কেজি বা তার বেশিও হয়ে থাকে। আবার একটি দেশি মুরগি বছরে ৫০-৬০টা ডিম দেয়, একটি তিতির পাখি বছরে প্রায় ১০০-১২০টি ডিম দেয়। তিতিরের মাংস ও ডিমে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গুণাগুণ বিদ্যমান । তিতিরের মাংস সুস্বাদু এবং ডিমের স্বাদ ও পুষ্টিগুন অনেক বেশি । অনেক বড় বড় হোটেল ও রেস্তোরায় এই তিতিরের মাংসের বেশ কদর আছে ।
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ‘ এ।