বেগুন চাষ
বিটি বেগুন: আয়ের সহজ পথ
কেউ বলে “গরিবের সবজি”, কেউ বলে “সবজির রাজা”। হ্যা, বাংলাদেশের মানুষের অতি পরিচিত সবজি বেগুনের কথা বলছি। প্রায় সারা বছরই দেশের সব শ্রেণীর লোকের কাছে খাদ্য তালিকায় বেগুন থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বেগুন চাষিদের আজ দুরবস্থা। বেগুন ক্ষেতে ফসলের রোগ, কীটপতঙ্গের আক্রমণ, সার-বীজ-কীটনাশক ব্যবস্থাপনা কৃষকের দুঃশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। তবে আশার কথা হচ্ছে, বিটি বেগুন পাল্টে দেবে কৃষকের এই দুরবস্থা। এ বেগুন চাষে লাগবে না কোন কীটনাশক; বাড়তি ফলনের পাশাপাশি আসবে স্বচ্ছলতা।
এ বেগুনকে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী করতে প্রায় এক দশক গবেষণার পর অবশেষে বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছেন। গবেষকরা বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেছেন বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী বেগুনের জাত এবং এই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ভারতে অবমুক্ত হতে যাচ্ছে এই বেগুন। নাম তার “বিটি ব্রিনজেল” বা বিটি বেগুন।
চীনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বেগুন উৎপাদনকারী দেশ ভারত প্রায় সাড়ে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে বেগুন উৎপাদন করে যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের শতকরা ২৬ ভাগ দখল করে আছে। অর্থকরী ফসল হিসেবে ১.৪ মিলিয়ন ছোট, বড় এবং সীমিত সম্পদের কৃষকরা বেগুন উৎপাদন করে। ভারতের প্রধান বেগুন উৎপাদনকারী অঙ্গরাজ্য হচ্ছে পশ্চিম বাংলা (৩০%), উড়িষ্যা (২০%) এবং গুজরাট (প্রায় ১০%)। ২০০৫-২০০৬ সালে গড় ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৫.৬ টন।
বিটি বেগুন কীটপতঙ্গ দমনে কীভাবে কাজ করে এবং তা কৃষকদের জন্য কি ধরনের সুফল বয়ে আনে তা নিয়ে ড. নাসির বলেন, ব্যাসিলাস্ থুরিন্জিয়েন্সিস (বিটি) নামক মাটির একটি ব্যাকটেরিয়ার ক্রাই ওয়ান এসি জিন বেগুনের মাঝে ট্রান্সফার করে বেগুনকে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধীজাত তৈরি করা হয়েছে। ক্রাই ওয়ান এসি জিনটি লেপিডোপটেরা বা প্রজাপতি পর্বের কীটপতঙ্গ যেমন, ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার মিডগাট বা মধ্যান্ত্রে ক্ষারীয় মাধ্যমে বিষাক্ত প্রোটিন তৈরি করে যা মধ্যান্ত্রের দেওয়ালে ছিদ্র সৃষ্টি করে এবং এই পোকা কিছুদিন পর খাদ্য গ্রহণ না করতে পেরে মারা যায়। এভাবে বিটি বেগুন কীটপতঙ্গ দমন করে। এতে করে কীটনাশক ছাড়াই বেগুনের ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়। ফলে কীটনাশক বাবদ কৃষকের খরচ বাঁচে, পাশাপাশি মাটিতে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন কীটনাশক থাকার সম্ভাবনাও থাকে না। মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে- বিটি বেগুন শতকরা ৯৮ ভাগ ডগা ছিদ্রকারী এবং ১০০ ভাগ ফল ছিদ্রকারী প্রতিরোধী। বিভিন্ন এলাকার মাঠ গবেষণা হতে দেখা যায়, বিটি বেগুন চাষে শতকরা ৪২ ভাগ কম কীটনাশক লাগে অন্যান্য কীটপতঙ্গ দমনে। এছাড়া বিটি বেগুন প্রচলিত বেগুনের হাইব্রিডের তুলনায় গড়ে শতকরা ১১৬ ভাগ বেশি বাজারজাত উপযোগী উৎপাদন বাড়ায়। এমনকি, বেগুনের মুক্ত পরাগায়ণের জাত থেকে গড়ে প্রায় শতকরা ১৬৬ ভাগ বেশি উৎপাদন হয়। গবেষকদের পরিসংখ্যান মতে, ভারতে বিটি বেগুন চাষিরা গড়ে প্রতি একর জমিতে প্রায় ২৩,০০০ টাকা থেকে ২৮,০০০ টাকা মুনাফা অর্জন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা যোগ করবে।
বিটি বেগুনের উদ্ভাবন বিষয়ে ড. নাসির বলেন, ২০০০ সালে ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সীড্স কোম্পানি (মাহিকো) সর্বপ্রথম তাদের বেগুনের হাইব্রিড তৈরির প্রোগ্রামের আওতায় ক্রাই ওয়ান এসি জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করে। মাহিকো কোম্পানি বিটি বেগুন টেকনোলোজি ভারতের তামিল নাডু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কইম্বাটর ও কৃষি বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল- মাহিকো কোম্পানি শর্তবিহীনভাবে এই বিটি বেগুন টেকনোলোজি বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন এর সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দান করেছে ।
এছাড়া বর্তমানে মাহিকো’র পাশাপাশি আরও কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানও আলাদা ধরনের জিন ব্যবহার করে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করছে। যেমন- ন্যাশনাল সেন্টার অন প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলোজি ক্রাই এফএওয়ান জিন ব্যবহার করে বিটি বেগুন তৈরি করছে এবং তারা এই প্রযুক্তি বেজো শীতাল, বিবাহ্ সীডস, নাথ সীডস এবং কৃষিধান সীডস কোম্পানিগুলোকে হস্তান্তর করেছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হর্টিকালচারাল রিসার্চ ক্রাই ওয়ান এবি জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিটি বেগুন তৈরি করছে। বর্তমানে একাধিক উপকারী বৈশিষ্ট্যের বিটি বেগুনের জাত তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
বিটি বেগুনের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীব নিরাপত্তা প্রশ্নে আইসা রিভিউ -এর তথ্য এবং ড. নাসির এর সূত্রে জানা যায়- খরগোশ, ইঁদুর, কার্প জাতীয় মাছ, ব্রয়লার, গরুর উপর বিটি বেগুনের অ্যালার্জি, বিষাক্ততা ও পুষ্টিমান সম্বলিত একাধিক এবং বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণে স্বাস্থ্যের জন্য কোন ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি বরং তা নন-বিটি ফসলের মতই নিরাপদ। বিটি বেগুন উপকারী পোকা যেমন- এফিড, লীফ হপার, মাকড়সা, লেডিবার্ড বিটল ইত্যাদি। মাটির উপকারী অণুজীব ও লক্ষ্যহীন অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে কোন ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে না। ভারত ২০০০ সালে বিটি বেগুন উদ্ভাবনের পর একাধিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মানুষ এবং পশুর খাদ্য, পরিবেশ ও জীব নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিটি বেগুন কতটুকু কৃষকের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে এই প্রশ্নে ড. নাসির বলেন, বাংলাদেশেও চলছে বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষামূলক চাষ। দেশের যশোর, হাটহাজারী ও গাজীপুরে বিটি বেগুনের পরীক্ষামূলক চাষে ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আমাদের দেশে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি সবজি ফসলের ফলনও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী বিটি বেগুন এই সব সমস্যা দূর করে ফোটাতে পারে কৃষকের মুখে হাসি। বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ কমে যাবে, কীটনাশক বাবদ কৃষককে প্রচুর খরচ কমবে, বাড়বে ফলন, লাভবান হবেন বেগুন চাষি।
লেখক: গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস, বাকৃবি, ময়মনসিংহ
শীতকালীন বেগুন চাষ
বেগুন সারা বছর পাওয়া যায়। দেশের সব জায়গায় এবং বসতবাড়িতেও চাষ করা যায়। এটা শীতেই সবচেয়ে ভালো হয়। কেননা গরমকালে তাপমাত্রা বেশি থাকায় বেগুনের ফুল ও ফল উৎপাদন ব্যাহত হয়, পোকা বেশি লাগে।
জাতের কথা : শীতকালে বেগুন চাষ করতে হলে জাত বাছাইয়ে সতর্ক হতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ পর্যন্ত বেগুনের প্রায় ১৫০টি জাতের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করেছে। এসব জাতের মধ্যে আট-দশটি জাত প্রধান। জাতগুলো হলোন্ধ শিংনাথ, ইসলামপুরী, খটখটিয়া, ঈশ্বরদী-১, দোহাজারী, চ্যাগা, ঝুমকা, কাঁটাবেগুন ইত্যাদি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দু’টি হাইব্রিড জাতসহ ১০টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো হলোন্ধ উত্তরা, তারাপুরী (হাইব্রিড), শুকতারা (হাইব্রিড), কাজলা, নয়নতারা, বারি বেগুন-৬, বারি বেগুন-৭, বারি বেগুন-৮, বারি বেগুন-৯ ও বারিবেগুন-১০। এসব জাতের মধ্যে শীতকালে চাষের জন্য বারি বেগুন-৪ (কাজলা) জাতটি সবচেয়ে ভালো। কেননা বেগুনের আকর্ষণীয় কালচে রঙ ও আকার অনেককে আকৃষ্ট করে। গাছে প্রচুর বেগুন ধরে, মার্চ মাস পর্যন্ত বেগুন পাওয়া যায় অর্থাৎ তাপমাত্রা বাড়লেও তার ধকল সইতে পারে। উচ্চফলনশীল এ জাতের গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৩০-৩৫, প্রতিটি ফলের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম, হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০-৫৫ টন। তাই চোখ বুজে শীতকালে চাষের জন্য এ জাতের বেগুন বেছে নেয়া যেতে পারে। অন্যান্য জাতের মধ্যে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্য ইসলামপুরী, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য দোহাজারী, রাজশাহী অঞ্চলের জন্য ঈশ্বরদী, যশোর অঞ্চলের জন্য চ্যাগা এবং রংপুর অঞ্চলের জন্য খটখটিয়া ভালো।
শীতকালে চাষের জন্য : বীজতলায় বীজ বুনে সেই চারা সরাসরি জমিতে না লাগিয়ে আরেকটি বীজতলায় দ্বিতীয়বার রোপণ করে চারা হৃষ্টপুষ্ট ও সবল করে লাগালে ভালো হয়। এ জন্য প্রথমে বীজতলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হয়। বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্খানান্তর করতে হয়। বীজতলায় মাটির সমপরিমাণ বালু, কমপোস্ট ও মাটি মিশিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়।
যেভাবে জমি তৈরি করতে হবে : জমিতে বেড তৈরি করে বেগুন চাষ করা ভালো। এতে বৃষ্টি হলে নিকাশের এবং পরিচর্যা ও চলাচলের সুবিধা হয়। বেডের আকার হওয়া উচিত ৭০ সেন্টিমিটার চওড়া ও জমির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী লম্বা।
সার প্রয়োগ : বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যের অভাব হলে গাছ বাড়ে না। খাদ্যের অল্পতা ফলনের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই বেগুন চাষের জন্য সুষমভাবে সার দেয়া উচিত।
চারা লাগানোর নিয়ম : রোপণ দূরত্ব নির্ভর করে জাত ও মাটির উর্বরতার ওপর। দুই বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ২০ সেন্টিমিটার গভীর নালা রাখা উচিত। সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব যেন ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার হয়।
সেচ দেয়া : বেডের দুই পাশের নালা দিয়ে জমিতে সেচ দেয়া সুবিধাজনক। নালায় সেচের পানি বেশিক্ষণ ধরে রাখা যাবে না। গাছের গোড়া পর্যন্ত মাটি ভিজে গেলে নালার পানি ছেড়ে দিতে হবে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।