হলুদ গাছে রোগের আক্রমণ ও প্রতিকার
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে গেলে এখন চোখ জুড়িয়ে যায়। বৃষ্টির সাথে সাথে গাছেরাও যেন আনন্দে মেতে উঠেছে। কাঁচা কাঁচা সবুজে মেখে আছে পাহাড়ের পুরো শরীর, ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে জুম ফসলের ধারা। তরতর করে বেড়ে উঠছে জুমের ফসলগুলো। ধানগাছ গর্ভবতী হচ্ছে। আর সেসব ধানগাছের সাথে দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে হলুদের গাছ। এ দৃশ্য দেখে নিশ্চয়ই জুমিয়াদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু ওদের কোথায় যেন এক টুকরো কষ্ট লেপে দিয়েছে হলুদগাছগুলো। গাছের পাতায় বাদামি পোড়া পোড়া দাগ। ওদের ভাষায় ওটা ব্যামো। ওই ব্যামো হলে তারা কী করেন? খাগড়াছড়ির জুম চাষি মাসা থ্রৈ মারমা বললেন, হলুদ গাছে ব্যামো না হলে আমরা হলুদ তুলি ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু ব্যামো হলে তার অনেক আগেই হলুদ তুলে ফেলতে হয়। না হলে গাছ মরে যায়, হলুদ পাওয়া যায় না। আগে তুললে তবু মন্দের ভালো কিছু হলুদ পাওয়া যায়। ব্যামো সারাতে তারা সাধারণত কোনো ব্যবস্খাই নেন না।শুধু পার্বত্য অঞ্চলের জুমের হলুদেই নয়, সমতলের হলুদ গাছেও এখন উল্টাপাল্টা বর্ষায় হলুদগাছে রোগ আক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। হলুদ গাছে সাধারণত তিনটি রোগের আক্রমণ দেখা যায়ন্ধ লিফ ব্লচ বা পাতা ঝলসা রোগ, লিফ স্পট বা পাতায় দাগ রোগ এবং কন্দ বা হলুদের মোথা পচা রোগ। প্রথম দু’টি রোগ এখন হলুদ গাছে দেখা যাচ্ছে। এ রোগ দুটোর লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
পাতা ঝলসা রোগ এ রোগে আক্রান্ত হলুদ গাছের পাতার উভয় পিঠেই প্রথমে অসংখ্য ছোট ছোট গোলাকার বাদামি দাগ দেখা যায়। দাগগুলো পাতার শিরার সমান্তরালে অবস্খান করে। ধীরে ধীরে দাগ বড় হতে থাকে এবং অনেকগুলো দাগ একসাথে মিলে পাতাকে ঝলসে ফেলে। তীব্রভাবে আক্রান্ত পাতা শেষে ঝরে পড়ে। আক্রান্ত শুকনো পাতা জমিতে পড়ে থাকলে সেখান থেকে বাতাসের সাহায্যে এ রোগের জীবাণু অন্যান্য সুস্খ গাছেও ছড়িয়ে পড়ে ও ক্ষেতের বেশির ভাগ গাছের পাতাকে ঝলসে ফেলে। Taphrina maculans নামক ছত্রাক জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়।
ব্যবস্খাপনা এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিয়মিত ক্ষেতে গিয়ে গাছ দেখতে হবে। আক্রমণের শুরুতেই রোগাক্রান্ত পাতা তুলে পুড়িয়ে ফেললে রোগ আর বাড়তে পারে না।
এর পরও রোগ দেখা দিলে প্রতি ১০ লিটার পানিতে (১ স্প্রে মেশিন পানি) ১০ মিলিলিটার (২ চা চামচ) ফলিকুর অথবা ২০ গ্রাম (৪ চা চামচ) ডায়থেন এম ৪৫ নামক ছত্রাকনাশক মিশিয়ে পাতার দু’পাশেই ভালো করে ক্ষেতের সব গাছে স্প্রে করতে হবে। ১৫ দিন পরপর তিন থেকে চারবার স্প্রে করলে এ রোগ সেরে যায়।
ভবিষ্যতে যাতে এ রোগ না হয় সে জন্য রোগাক্রান্ত কোনো ক্ষেত থেকে বীজ হিসেবে কন্দ বা মোথা রাখা যাবে না। এমনকি বীজকন্দ লাগানোর আগে সেগুলো ব্যাভিস্টিন বা ডায়থেন এম ৪৫ দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। একই জমিতে পরপর দুই থেকে তিন বছর হলুদের চাষ না করা ভালো।
পাতায় দাগ রোগ একটানা উচ্চ আর্দ্রতাসম্পন্ন আবহাওয়া এ রোগের অনুকূল। ঘনঘন বৃষ্টি ও গরম এ রোগ বাড়িয়ে দেয়। এ দেশে সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এ রোগ বেশি দেখা যায়। তবে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্তও এ রোগ চলতে থাকে। আক্রান্ত গাছের শুকনো পাতার মধ্যে এ রোগের জীবাণু এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। সেখান থেকে বাতাস, পানি ইত্যাদি দ্বারা রোগ ছড়ায়। Colletotrichum capsici নামক ছত্রাক জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়।
এ রোগের আক্রমণে প্রথমে পাতায় আয়ত গোলাকার দাগ পড়ে। দাগের চার পাশে বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি বলয় থাকে এবং দাগের মাঝখানে থাকে ধূসর রঙ। গোটা দাগের চার পাশে হলুদ আভাযুক্ত বলয় তৈরি হয়। ধীরে ধীরে দাগগুলো বড় হতে থাকে এবং পাতার অনেকটা অংশজুড়ে দাগের সৃষ্টি হয়। তীব্র আক্রমণে পাতার সম্পূর্ণ অংশই পুড়ে যাওয়ার মতো হয়ে যায় ও আক্রান্ত পাতা ঢলে যায় এবং শেষে শুকিয়ে যায়।
ব্যবস্খাপনা রোগাক্রান্ত এবং শুকনো পাতা গাছ থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
রোগ দেখামাত্র আক্রান্ত পাতা তুলে ফেলার পর ক্ষেতের বাকি গাছগুলোতে কান্ডোজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমন ব্যাভিস্টিন) অথবা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমন ডায়থেন এম ৪৫) স্প্রে করতে হবে। প্রতি ১০ লিটার পানিতে (১ স্প্রে মেশিন পানি) ২০ গ্রাম (৪ চা চামচ) ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ক্ষেতের সব গাছে স্প্রে করতে হবে। ১৫ দিন পরপর তিন থেকে চার বার স্প্রে করলে এ রোগ সেরে যায়।
ক্ষেত সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। হলুদ গাছের শুকনো পাতা পরিষ্কার করতে হবে।
ভবিষ্যতে যাতে এ রোগ না হয় সে জন্য রোগাক্রান্ত কোনো ক্ষেত থেকে বীজ হিসেবে কন্দ বা মোথা রাখা যাবে না। এমনকি বীজকন্দ লাগানোর আগে সেগুলো ব্যাভিস্টিন বা ডায়থেন এম ৪৫ দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ থেকে বীজ হলুদ রাখা চলবে না।
একই জমিতে পরপর হলুদের চাষ না করে অন্য ফসলের চাষ করতে হবে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।