লেবু গাছ

লেবু চাষে রোগবালাই ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

আমাদের দেশে নানা ধরনের লেবু পাওয়া যায়। যেমন- জাড়ালেবু, গন্ধরাজলেবু, কাগজিলেবু, মোসম্বী, সর্বতিলেবু, কমলালেবু ইত্যাদি। অপরিপক্ক অবস্থায় লেবুজাতীয় ফল ঝরে পড়া এক ধরনের জটিল সমস্যা। এক সমীক্ষাতে দেখা গেছে, ফল তোলার ৩-৪ মাস আগে থেকে লাল মাল্টার ৫৭.২ শতাংশ এবং মোসম্বীতে ৫৪.৯ শতাংশ ফল ঝরে পড়ে।

লেবু জাতীয় গাছের ফল অনেক কারণে ঝরে পড়তে পারে। এর মধ্যে হরমোনজনিত, খাদ্যজনিত, রোগজনিত এবং পোকাজনিত কারণই প্রধান। গাছের বৃদ্ধি এবং ফল-ফুল দেওয়ার জন্য সুষম হারে খাদ্যের প্রয়োজন। গাছের প্রধান খাদ্য নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ জাতীয় খাদ্য ছাড়াও গাছের নানা ধরনের অনুখাদ্যের প্রয়োজন। এ অনুখাদ্য খুব কম পরিমাণে দরকার হয় যদিও সময়মত এসব প্রয়োগ না করার ফলে বা গাছ অনুখাদ্য না পাওয়ার জন্য অপরিপক্ক অবস্থায় অনেক ফল ঝরে পড়ে। নানা রোগের কারণে লেবুজাতীয় গাছে অপরিপক্ক অবস্থায় ঝরে যায়। যেমন- ক্যাঙ্কার, স্বেব, গামোসিস, এ্যানথ্রাকনোজ, গ্রিনিং এবং শ্লো ডিক্লাইন বা ধীরে ধীরে গাছ মরে যাওয়া রোগ হয়। গাছে এসব রোগ হলে ফুল-ফল কম ধরে এবং ফুল-ফল শুকিয়ে ঝরে পড়ে।

লেবুজাতীয় গাছের অপরিপক্ক অবস্থায় ফল ঝরে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল পোকার আক্রমণ। নানাবিধ পোকার মধ্যে ডাল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, সাইলা, মিলিবাগ, লিফমাইনার, ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং ফল শোষক পোকার আক্রমণের ফলে ফল ঝরে পড়ে। লেবুর ডাল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা ডাল এবং কাণ্ডের ভেতরে প্রবেশ করে ভেতরের অংশ কুরে কুরে খায়। এদের আক্রমণের ফলে শাখা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় এবং ডালে এর আক্রমণ হয় সে ডালটিতে হওয়া ফুল এবং ফল ঝরে পড়ে। লেবুর পাতা ছিদ্রকারী পোকা বা লিফমাইনার পোকার শূককীট পাতায় ঢুকে উপরেরও নিচের ত্বকের মধ্যে থাকা সবুজ অংশ খেয়ে নেয়। পাতার উপর ত্বকে সাদা রূপালি আঁকাবাঁকা রেখা দেখা যায়। আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে যায় এবং এ ধরনের গাছে হওয়া ফল ঝরে পড়ে।

সাইলা পোকা লেবুজাতীয় গাছের কচি ডাল এবং পাতাতে আক্রমণ করে এবং রস শুষে খায়। রস শুষে নেওয়ার সময় এ পোকা গাছে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ঢুকিয়ে দেয়। এর আক্রমণের ফলে ডালগুলো শুকিয়ে যায় এবং সে ডালগুলোর ফুল এবং ফল ঝরে পড়ে।

মিলিবাগ পোকার প্রাপ্তবয়স্ক মাতৃপোকা মাটিতে ডিম পাড়ে এবং সে ডিম থেকে বের হওয়া শূককীট ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত গাছে উঠে। গাছে উঠে পোকাগুলো কচি ডালের রস চুষে খায় এবং হওয়ার সময় সেগুলো বা ফলধারক ডালটির রস খায়। ফলে ফল ঝরে পড়ে। এ পোকা পাতার উপর এক ধরনের মিষ্টিরস নিঃসরণ করে এবং এ রসের উপর এক প্রকার ছত্রাক জন্মে থাকে। তাই পাতার উপরে এক কালো আস্তরণ পড়ে এবং গাছের খাদ্য প্রস্তুত করার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে ফল ঝরে পড়ে এবং যেগুলো ফল গাছে থাকে তা পুষ্ট হয় না। ফল চোষক পোকা লেবুজাতীয় ফলের রস চুষে খায়। রস চোষার সময় তার মুখ থেকে নির্গত পদার্থ ফলের ভেতরে প্রবেশ করে। এর ফলে ২-৩ দিনের মধ্যে ফল ঝরে পড়ে। রস চোষা অংশে বাদামী রঙের দাগ দেখা যায়।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা: লেবুজাতীয় গাছের অপরিপক্ক অবস্থায় ফল ঝরে পড়া বন্ধ করার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে-
১. গাছে সুষম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে;

২. গাছে অনুখাদ্যের অভাবের লক্ষণ দেখা দিলে অনুখাদ্যের মিশ্রণ প্রয়োগ করা দরকার। বাজারে পাওয়া তৈরি অনুখাদ্য যেমন- মাল্টিপ্লেকস, এগ্রোমিন, ট্রেসেল-২, প্লাই এইড, এগ্রোমর বা প্লান্টফিড প্রভৃতির যেকোনো একটি পরিমাণমত প্রয়োগ করতে হবে;

৩. হরমোন জাতীয় কারণে ফল ঝরে পড়লে গাছে হরমোন স্প্রে করা দরকার। এর জন্য ২,৪-ডি নামক হরমোন ১০ পিপিএম গাছে ২ বার স্প্রে করতে হবে। প্রথমবার আগস্ট মাসে এবং পরের বার অক্টোবর মাসে স্প্রে করা দরকার। এ ওষুধ বাজারে পাওয়া না গেলে ১০-১২ পিপিএম শক্তিযুক্ত প্লেনোফিকস হরমোন ফুল আসার সময় এবং একবার একমাস পর স্প্রে করতে হবে;

৪. বিভিন্ন ধরনের রোগের জন্য সময়মত প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না তা দেখতে হবে। গাছের গোড়ায় আঠা নিঃসরণ হতে দেখলে অর্থাৎ গামোসিস রোগ হলে সে অংশ পরিষ্কার করে তাতে বর্ডোমলম লাগাতে হবে। ক্যাঙ্কার এবং এ্যানথ্রাকনোজ রোগ হলে আক্রান্ত কচি ডালপালা, পাতা ছেটে ফেলে দূরে নিয়ে ধ্বংস করতে হবে। পরে গাছে ব্লাইটকস/ফাইটোলান (৪ গ্রাম/লিটার পানি) অথবা ইন্দোফিল এম-৪৫ (২.৫ গ্রাম/ লিটার পানিতে) স্প্রে করতে হবে;

৫. গাছে ডাল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে আক্রান্ত ডালগুলো কেটে ধ্বংস করতে হবে। কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকার প্রাপ্তবয়স্ক পোকা এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বের হয়ে গাছে বসে। সে সময় এগুলো ধরে মেরে ফেলা উচিত। কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকার গর্তে পেট্রোল বা কেরোসিন ডুবানো কার্পাস তুলো ঢুকিয়ে তা কাদামাটি দিয়ে ঢেকে দিলে পোকা ভেতরে মরে যাবে।
ফল খাওয়া পোকা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফল মার্বেলের মত সাইজ হওয়ার সময় এন্ডাসালফান ওষুধ ০.০৭ শতাংশ স্প্রে করে প্রথম স্প্রে করার ৭ দিন পরপর ফলের বৃদ্ধির সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত স্প্রে করতে হবে। ফলের মাছি এবং ফল চোষা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে সেখানে কিছু কমলালেবুর রস মিশিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। পোকা এ গুড় মিশ্রিত রস খেয়ে মরে যাবে। পোকা আক্রান্ত ফলগুলো সংগ্রহ গর্তে পুঁতে রাখলে পরবর্তী ফসলে পোকার আক্রমণ কম হবে। এ ব্যবস্থাসমূহ নিয়ে লেবুর ফল ঝরে পড়ে যাওয়া সমস্যা অনেকাংশে বন্ধ করা যাবে।
লেখক: আফতাব চৌধুরী, সিলেট

এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।