রেণু পোনার প্রস্তুতি
মাছ চাষে মানসম্মত পোনার ভূমিকা প্রশ্নাতীত। মজুদ পুকুরে ছাড়ার জন্য নির্বাচিত পোনা আলাদাভাবে লালন-পালন করে চাষের উপযোগী করা হয়। এ জন্য আলাদাভাবে বিশেষ যত্নে পালনের জন্য রেণু সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত দুটো উৎস থেকে রেণু সংগ্রহ করা সম্ভব। একটি উৎস হচ্ছে নদী এবং অন্যটি হ্যাচারি। হালদা, পদ্মা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ প্রভৃতি নদী থেকে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বিভিন্ন মাছের রেণু ধরা পড়ে। যাঁরা হ্যাচারি থেকে রেণু সংগ্রহ করে পালন করে থাকেন, তাঁরা এখন থেকেই কাজ শুরু করতে পারেন।
ভালো রেণু : মানসম্মত রেণু কোথায় পাব বা কিভাবে পাওয়া যাবে এটা অনেকেরই প্রশ্ন। তা ছাড়া নদী থেকে প্রাপ্ত বা প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত রেণু ভালো, নাকি হ্যাচারির উৎপাদিত রেণু ভালো-এটাও অনেকেরই প্রশ্ন। সাধারণত পরিপূর্ণ এবং অনুকূল পরিবেশে পরিপক্ব মাছের প্রজনন ঘটে বলে স্বাভাবিকভাবেই নদী থেকে প্রাপ্ত রেণুর মান ভালো হয়। তবে এ ক্ষেত্রে যে সমস্যা হতে পারে তা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির রেণুর মিশ্রণ থাকে বলে তা বাছাই করা সহজ হয় না। অন্যদিকে হ্যাচারির রেণুতে প্রজাতির মিশ্রণ না ঘটিয়ে নির্দিষ্ট প্রজাতির রেণু সংগ্রহ ও লালন-পালন করা সম্ভব, তবে ব্রুড মাছের মান নিয়ন্ত্রণ না করলে এবং হ্যাচারির ব্যবস্থাপনায় সতর্ক না হলে নিম্নমানের রেণু বা সংকর জাতের মাছের রেণু উৎপাদিত হতে পারে, যা পরে চাষির ক্ষতির কারণ হতে পারে।
রেণু লালনের পুকুর প্রস্তুত সাধারণত অগভীর বার্ষিক পুকুর বা চাষের মৌসুমে পানি থাকে এমন মৌসুমি পুকুর রেণু লালনের জন্য উত্তম। রেণু লালনের জন্য পুকুর হবে-পুকুরের চার পাড় উঁচু, বন্যামুক্ত ও মজবুত হতে হবে এবং পুকুরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকবে। বর্ষাকালে পানির গভীরতা দুই মিটারের বেশি হবে না। পুকুরের তলদেশে বেশি কাদা থাকবে না। পুকুরের আয়তন ১০-৫০ শতাংশ হতে পারে।
পুকুর : পুকুর নতুনভাবে প্রস্তুত বা কাটা হলে রাক্ষুসে মাছ বা অন্যান্য মাছ অপসারণের ঝামেলা থাকে না, তবে পুরনো পুকুর হলে সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে তলদেশে রোদ লাগাতে হবে এবং একই সঙ্গে পুকুরের পাড় মেরামত এবং পাড়ের গাছপালা বা আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। যদি পানি শুকানো সম্ভব না হয়, তাহলে রোটেনন (নির্ধারিত মাত্রায়) ব্যবহারের মাধ্যমে রাক্ষুসে মাছ এবং আগাছাসহ সব জলজ প্রাণী নির্মূল করা আবশ্যক।
চুন সার : পুকুর প্রস্তুতির দ্বিতীয় ধাপে প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। নতুন ও পুরনো উভয় পুকুরেই সার প্রয়োগ করতে হবে, প্রথমে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ বা সম্ভব হলে পুকুর শুকানোর পর প্রতি শতাংশে পাঁচ-সাত কেজি গোবর বা কম্পোস্ট আট-দশ কেজি বা হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা তিন-পাঁচ কেজি এবং ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি একই সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
পানি প্রবেশ : সার প্রয়োগের পরপরই নিরাপদ উৎস থেকে ২-২.৫ ফুট পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে হবে। তবে অবশ্যই প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি প্রবেশ করালে তার আগে পাইপের মুখে বা নালায় জাল স্থাপন করতে হবে, যাতে এ পানির সঙ্গে অন্য কোনো জলজ প্রাণী বা কীট বা মাছ প্রবেশ করতে না পারে। পানি প্রবেশের চার-পাঁচ দিন পর পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য বা প্লাংটন জন্মাবে এবং এ সময় পানির রং হালকা সবুজ হবে।
কীটপতঙ্গ দমন : সার প্রয়োগের পর বেশ কিছু প্রজাতির কীটপতঙ্গও দেখা যায়, যা রেণুর জন্য ক্ষতিকর। যেমন- ক্লাডোসিরা, হাঁসপোকা প্রভৃতি। এসব কীট থাকলে রেণুর মড়ক হয়। এ কারণে রেণু ছাড়ার আগে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাধারণত রেণু ছাড়ার দু-এক দিন আগে ৬-১২ গ্রাম/শতাংশ/প্রতি ৩০ সেমি পানি হিসেবে ডিপটারেক্স ব্যবহার করতে হবে, তাহলে ক্লাডোসিরা, হাঁসপোকা এবং কপিপোড মারা যাবে। তবে রেণুর খাদ্য রটিফার ঠিকই বেঁচে থাকবে। ডিপটারেক্স পাওয়া না গেলে রেণু ছাড়ার ১২-১৫ ঘণ্টা আগে পুকুরে ২-৩ মিলি/শতাংশ/৩০ সেমি পানি হিসেবে সুমিথিয়ন প্রয়োগ করলেও সুফল পাওয়া যাবে। তা ছাড়া শতাংশ প্রতি ১২০-১২৫ মিলি হারে কেরোসিন বা ডিজেল প্রয়োগ করেও জলজ পোকা আংশিক দমন করা যায়। জলজ পোকা দমনের জন্য ডিপটারেক্স বা সুমিথিয়ন ব্যবহারের পর মশারির জাল টেনে মরা পোকা ছেঁকে তুলে নেওয়া আবশ্যক।
রেণু মজুদ : রেণু মজুদ ঘনত্ব নির্ভর করে রেণু পালনের সময়কাল এবং পুকুরের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে। যদি একই পুকুরে রেণু পোনা ছেড়ে চারা পোনা (৭-১৫ সেমি) পর্যন্ত বড় করা হয়, তাহলে তাকে ‘এক স্তর পদ্ধতি’ বলে আবার যদি একটি ছোট পুকুরে রেণু ছেড়ে কয়েক দিন পর অন্য কয়েকটি পুকুরে কম ঘনত্বে ধানি পোনা স্থানান্তর করা হয়, তাহলে সে পদ্ধতিকে বলে ‘দ্বি-স্তর পদ্ধতি’। এ ক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতির প্রায় তিন গুণ রেণু মজুদ করা যায়। একস্তর পদ্ধতিতে রেণু পালনের ক্ষেত্রে শতাংশে ৬-৮ গ্রাম এবং দ্বি-স্তর পদ্ধতিতে ২৫-৩০ গ্রাম রেণু মজুদ করা সম্ভব।
সতর্কতা : অক্সিজেন ব্যাগে রেণু পরিবহন করতে হবে এবং পরিবহনকালীন ধকল যত কম হবে, পোনা মৃত্যুর হার তত কম হবে। রেণু ছাড়ার আগে পুকুরের পানি এবং রেণুর ব্যাগের পানির তাপমাত্রা সমতায় আনতে হবে। পুকুরের পাড়ের কাছাকাছি রেণু ছাড়তে হবে। সকাল বা বিকেলে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রেণু ছাড়া উচিত।
খাবার : রেণুর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য থাকা আবশ্যক। এ কারণে রেণু পালন পুকুরে নিয়মিতভাবে সার প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে দৈনিক গোবর ২০০ গ্রাম বা কম্পোস্ট ৩০০-৪০০ গ্রাম বা হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ১৫০-২০০ গ্রাম এবং ইউরিয়া চার-পাঁচ গ্রাম ও টিএসপি তিন গ্রাম একত্রে পানিতে গুলে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। তা ছাড়া সম্পূরক খাবার হিসেবে চালের কুঁড়া এবং সরিষার খৈল প্রয়োগ করা যায়। এ ক্ষেত্রে কুঁড়া ও খৈল ৫০: ৫০ অনুপাতে প্রয়োগ করা যায়।
লেখক: মোহাম্মদ তারেক সরকার
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।