সামাজিক বনায়ন

বনায়ন

বনায়ন বর্তমান বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা আর শিল্প বিপ্লবের বেগবান গতিতে আমাদের চিরচেনা প্রকৃতি আজ তার রুপ-যৌবন হারাতে বসেছে।আমরা হারাতে বসেছি বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন নিমর্ল পরিবেশ। তাই সুস্থ-সুন্দর জীবনের জন্য সবুজ প্রকৃতি রক্ষার্তে গাছ লাগানোর মাধ্যমে বনায়ন ব্যাতীত বিকল্প কোন পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। আর এ জন্য আমাদেরকে প্রথমেই জানতে হবে কি কি গাছ কোথায় কোথায় লাগাতে হবে।

গাছ

কোথায় লাগাবেন কি গাছ ?

পরিবেশ রক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চারিদিকে চলছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাই সঠিক স্থানে সঠিক চারা রোপনের সময় এখনই। জেলা ও উপজেলা বৃক্ষমেলা কিংবা নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা যায়। সুস্থ, সবল, মধ্যমাকৃতির, পরবর্তী বংশধরদের কথা চিন্তা করে ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা লাগানোর প্রতি বেশি নজর দেয়া উচিত। এতে ফল, ঔষধ এবং কাঠ সবই পাওয়া যায়। বন্যামুক্ত, আলোবাতাস চলাচল করতে পারে এবং সূর্যালোক পড়ে এমন জায়গায় চারা রোপণ করা উচিত। দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ, উর্বর, নিষ্কাশনযোগ্য ও উঁচু স্থানে চারা রোপণ করা উত্তম। কোথায় কোন চারা রোপণ করা উচিত তা জেনে নেই।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে: যেমন- মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে ও আশেপাশে শোভাবর্ধনকারী এবং ছায়া দানকারী গাছ যেমন, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, তাল, খেজুর, নিম, পাম, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ রোপণ করতে পারেন।

বসতবাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে: রোদ ও আলোর জন্য ছোট এবং কম ঝোপালো গাছ লাগাতে হবে। সুপারি, নারিকেল, নিম, দেবদারু, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, ডালিম, মেহেদী, গাছ লাগানো যেতে পারে।

বসতবাড়ির পূর্ব-পশ্চিমে: মাঝারি উঁচু এবং মাঝারি ঝোপালো গাছ লাগাতে হবে। এতে সকাল-সন্ধ্যায় বাড়ির আঙ্গিনায় আলো থাকবে। বাউকুল, আপেলকুল, সফেদা, আম্রপালি, লিচু, খেজুর, ডালিম, কলা, আতা, বেল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছ।

বসতবাড়ির উত্তরে: বসতবাড়ির উত্তরপাশে বড় ও উঁচু গাছপালা থাকলে ঝড়-তুফান প্রতিরোধ হয়। এখানে আম, কাঁঠাল, জাম, কামরাঙ্গা, মেহগনি, শিশু, সেগুন, হরিতকি, আকাশমণি, বাঁশ, ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।

পতিত জমিতে: সব ধরনের গাছ যেমন- আম, কাঁঠাল, জাম, কামরাঙ্গা, মেহগনি, শিশু, সেগুন, হরিতকি, আকাশমণি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, বাঁশ ইত্যাদি।

হাট-বাজারে: ছায়দানকারী গাছ রোপণ করা উচিত। আম, কাঁঠাল, জাম, সেগুন, দেবদারু, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, কৃষ্ণচূড়া, বটগাছ রোপণ করা উচিত।

রাস্তার পাশে: উঁচু, ও ডালপালা ছাঁটাই করা যায় এমন গাছ রোপণ করা দরকার। মেহগনি, শিশু, সেগুন, হরিতকি, আকাশমণি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, বাবলা, ইপিল ইপিল, শিমুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়। গাঁয়ের পথের দু’ধারে বা ফিডার রোডের পাশে শিশু, নিম, দেবদারু, চম্পা, ইপিল ইপিল, পাইন্যাগোলা বা লুকলুকি, মান্দার, পালিত মাদার, পানিয়া মাদার, বাবলা, খয়ের, বকফুল, তাল, খেজুর ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে। বড় রাস্তা বা মহাসড়কের পাশে কৃষচূড়া, কনকচূড়া, রেইনট্রি, গগন শিরীষ, রাজকড়ই, শিলকড়ই, শিশু, মেহগনি, অর্জুন, দেবদারু, সোনালু, নিম, নাগেশ্বর, আকাশমণি, বকুল, পলাশ, তেলসুর, ঝাউ, বটল পাম প্রভৃতি গাছ লাগানো যায়।

রেল লাইনের পাশে: মেহগনি, শিশু, সেগুন, আকাশমণি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, শিমুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।

বাঁধের ধারে: শেকড় শক্ত এবং বিস্তৃত এমন গাছ যেমন বট, আমড়া, বাঁশ, মেহগনি, শিশু, সেগুন, আকাশমণি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর ইত্যাদি গাছ রোপণ করা দরকার।

জমির আইলে: যেসব গাছের শেকড় কম বিস্তৃত কম ছায়াদানকারী, ডালপালা ছাঁটাই করা যায় যেমন- মেহগনি, দেবদারু ইত্যাদি গাছ রোপণ করতে হবে। আজকাল জমির ভেতরেও গাছ লাগানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই ইউক্যালিপটাসকে বেছে নিয়েছেন। ফসলের ক্ষেতে দূরে দূরে অল্প কিছু এরূপ গাছ লাগানো যেতে পারে। বরেন্দ্র এলাকায় এখন ধানের জমিতে মাটির ঢিবি তৈরি করে সেখানে ব্যাপক হারে আমগাছ লাগানো হচ্ছে। এমনকি জমির আইলেও অনেক গাছ লাগানো হয়। অনেক জায়গায় আইলে তালগাছ লাগিয়ে বাড়তি লাভ পাওয়া গেছে। তাল ছাড়া খেজুর, সুপারি, বাবলা, বকাইন, জিগা, কড়ই, ইউক্যালিপটাস, পালিত মাদার ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে।

নিচু জমিতে: জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এমন গাছ রোপণ করা দরকার। পিটালি, বেত, মূর্তা, বাঁশ, মান্দার, জারুল, হিজল, কদম ইত্যাদি গাছ নিচু জমিতে রোপণ করা যেতে পারে।

পুকুর পাড়ে: মাটি ভাঙ্গে না এবং শোভাবর্ধন করে যেমন সুপারি, নারিকেল, নিম, দেবদারু, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, ডালিম ইত্যাদি গাছ লাগানো যায়।

নদীর ধারে: পানি সহিষ্ণু, শক্ত মজবুত ও বড় হয় এমন গাছ রোপণ করা উচিত। যেমন- শিমুল, ছাতিম, পিটালি, বেত, বাঁশ, মূর্তা, মান্দার, জারুল, হিজল, কদম ইত্যাদি।

বিলে লাগানোর গাছ: বিল এলাকা যেখানে বছরে দু-তিন মাস পানি জমে থাকে সেখানে হিজল, করচ, বিয়াস, পিটালী, জারুল, মান্দার, বরুণ, পলাশ, কদম, চালতা, পুতিজাম, ঢেপাজাম, রয়না বা পিতরাজ, অর্জুন ইত্যাদি গাছ লাগানো যায়।

চরে লাগানোর গাছ: উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন জেগে ওঠা চরে কেওড়া, বাইন, কাঁকড়া, গরান, গোলপাতা গাছ লাগানো যায়। তবে উপকূলে যেসব চর একটু উঁচু ও স্বাভাবিক জোয়ারের পানি ওঠে না সেসব চরে বাবলা, ঝাউ, সনবলই, সাদা কড়ই, কালো কড়ই, জারুল, রেইনট্রি ইত্যাদি লাগানো যায়। উপকূল ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ঝাউ, লোনাঝাউ, পিটালী, করচ, পানিবিয়াস লাগানো যেতে পারে।

উপকূলীয় অঞ্চলে: লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে, হালকা পাতাবিশিষ্ট গাছ যেমন- সুন্দরী, ছৈলা, গরান, গেওয়া, গোলপাতা, মান্দার, কড়াই, বাবলা, নারিকেল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা উচিত।

উঁচু পাহাড়: বর্তমানে দেশের অনেক পাহাড়ি জমিতে কমলালেবুসহ বিভিন্ন প্রজাতির লেবু, লিচু, আম, পেয়ারা, গোল মরিচ, আদা, আনারসের সফল বিস্তার ঘটেছে। এছাড়াও তেলসুর, চাপালিশ, চিকরাশি, শিলকড়াই, গর্জন, গামার, সেগুন, ইপিল-ইপিল, বাঁশ, কাজুবাদাম প্রভৃতি কাঠের চাহিদা মেটাতে সহায়ক।

বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা: চারা লাগিয়ে ফলের আশায় বসে থাকলে হবে না। সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। যেমন- বাগানে পরিচর্যার ফলে ২০ থেকে ৪০ ভাগ ফল বেশি উত্পাদন সম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিচর্যার কথা উল্লেখ করা হল-
১. চারা রোপণের সাথে সাথে শক্ত কাঠি দিয়ে চারা সোজা করে বেঁধে দিতে হবে;
২. গরু-ছাগলের নাগাল থেকে রক্ষার জন্য বাঁশের খাঁচা দিয়ে চারা রক্ষা করতে হবে;
৩. চারার গোড়ায় জন্মানো অবাঞ্চিত আগাছা বাড়ন্ত চারার খাবারে ভাগ বসায়, তাই নিয়মিত আগাছা দমন জরুরি;
৪. শীতকালে, মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে শুকনো লতাপাতা, খড়, কচুরিপানা দিয়ে চারার গোড়ায় মালচিং করতে হবে;
৫. কোনো চারা দুর্বল, রোগাক্রান্ত বা মারা গেলে ওই জায়গায় আর একটি নতুন সবল চারা লাগাতে হবে;
৬. চারা সোজা রাখা ও নির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক রাখতে অবাঞ্চিত ডালপালা কেটে ফেলতে হবে;
৭. বৃষ্টি না হলে রোপণের পর ঝরণা দিয়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে;
৮. চারার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য রোপণের একমাস পর গোড়ার একফুট দূর দিয়ে নালা তৈরি করে এতে ১০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে;
৯. ফলগাছের বেলায় প্রতি বছর বর্ষার পূর্বে একবার (বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ) ও বর্ষা শেষে (ভাদ্র-অশ্বিন) আর একবার বয়স এবং জাতভেদে পরিমাণমত জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে;
১০. প্রতিবছর ফল পাড়ার পর পুরানো, রোগাক্রান্ত, মরা ডালপালা ছেটে দিয়ে রোদ ও আলো বাতাস চলাচল বাড়িয়ে দিতে পারলে পরের বছর নতুন ডাল পালায় ফুল-ফল বেশি ধরবে;
১১. রোগবালাই পোকামাকড় দমনের জন্য নিকটস্থ কৃষি বিভাগ, হর্টিকালচার সেন্টার বা বন বিভাগের পরামর্শমত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সারকথা: যেমন জায়গা তেমন গাছ তো হলো। কিন্তু গাছ নির্বাচন করলেই তো সব হয় না। সেগুলো লাগানোর ক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় রেখে লাগানো দরকার। লাগানোর আগে ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে। যেমনন্ধ রাস্তার ধারে যতই বলা হোক চম্বল বা গগন শিরীষ ও ইউক্যালিপটাস লাগাতে, যদি সে রাস্তার পাশ দিয়ে বিদ্যুতের তার যায় তাহলে সেখানে তা লাগানো যাবে না। ফসলি জমিকে বেশি ছায়া দিতে পারে এমন গাছ না লাগানো উচিত। পুকুরপাড়ে পাতা ঝরা বৃক্ষ যেমন কাঠবাদাম, শিমুল, মান্দার গাছ লাগানো যাবে না। কাঠগাছের বাগান করলে বেশ কয়েক রকমের গাছ লাগিয়ে মিশ্রভাবে করা ভালো। গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত প্রথম দু’বছর গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ফসল চাষ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিল, সরিষা, হলুদ, মুগ ও মাষকলাইয়ের চাষ করা যায়। এর পর থেকে কিছু গাছ কেটে পাতলা করে দিতে হবে এবং বেয়াড়া ডালপালা ছেঁটে গাছকে সোজা ও লম্বাভাবে বাড়তে দিতে হবে। এতে গাছের লগ ভালো হয়, কাঠমূল্য বাড়ে। কাঠের গাছ নির্দিষ্ট বয়সে এলে তাতে সার হয়, কাঠের দাম কয়েক গুণ বাড়ে। তাই বয়স অনুযায়ী সার বানিয়ে গাছ কাটতে হবে, অল্প বয়সী গাছ অযথা কাটা ঠিক নয়। এসব নিয়ম মেনে গাছ লাগালে বেশি লাভ হবে।

সরকারি-বেসরকারি নার্সারি, বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলা, এনজিও নার্সারি, ব্যক্তিগত নার্সারি, বিএডিসির নার্সারি, কৃষি গবেষণার নার্সারিতে ভাল চারা পাওয়া যায়। দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য কলমের জন্য চারা রোপণ করা উত্তম। যে কোন পরামর্শের জন্য আপনার নিকটস্থ কৃষি পরামর্শ কেন্দ্র উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করুন।
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।