গো-খাদ্য : ধানের সাথে সমন্বিত ফডার খেশারি
গুঁড়োদুধে মেলামিনের অতিমাত্রায় উপস্থিতির কারণে তরল দুধের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প কোন পথ নেই এ কথা দেশে ডেয়রি শিল্পের বিপ্লব সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দুগ্ধ বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তরল দুধ উৎপাদনে গো-খাদ্যের মূল অন-রায় হচ্ছে সবুজ ঘাস। শস্য উৎপাদন ব্যহত না করে মোট চাহিদার অর্ধেক গো-খাদ্য তথা সবুজ ঘাসের ঘাটতি কীভাবে মেটানো যায় এটাই প্রশ্নের বিষয়। এ ঘাটতি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে তরল দুধ উৎপাদনে গো-খাদ্য হিসাবে ধানের সাথে সমন্বিত ফডার খেশারি চাষ উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখতে পারবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের ডীন ও পশুপুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আলী আকবর। ধানের সাথে সমন্বিত ফডার খেশারি চাষ সম্পর্কিত আধুনিক ও লাগসই এ প্রযুক্তি সম্পর্কে অধ্যাপক ড. আলী আকবর এ প্রতিবেদককে নিন্মোক্ত প্রযুক্তিগত তথ্য দেন-
ফডার খেশারি আমিষ সমৃদ্ধ লিগুমিনাস ঘাস। এটি একদিকে যেমন পশুখাদ্যের সংস্থাপন করে, অন্যদিকে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। এতে পুষ্টিমান হিসেবে শুষ্ক পদার্থ থাকে ১৭.২ ভাগ, আমিষ ২৪.৫ ভাগ, ফ্যাট ৪.৫ ভাগ, আঁশ ২৪.৬ ভাগ এবং খনিজ উপাদান ৮ ভাগ এবং এর হজম ক্ষমতা বেশি, যা গবাদিপশুর পুষ্টির চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করে।
চাষ পদ্ধতি:
খু্ব শক্ত, কর্দমাক্ত, শুষ্ক ও এমন কি লবণাক্ত জমিতেও ফডার খেশারি চাষ করা যায়। বাংলাদেশের সকল জেলায় ধানের জমিতে এই ঘাস চাষ করা যায়। রিলে ফডার হিসেবে ফডার খেশারি বাংলা কার্তিক বা ইংরেজী নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে আমন ধানের সাথে চাষ করতে হয়। আমন ধান কাটার ১৫ দিন পূর্বে ধানের জমিতে খেসারির বীজ সমভাবে ছিটিয়ে বপন করতে হবে। একর প্রতি বীজের পরিমাণ ৩৫ কেজি। বীজ ছিটানো সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন ধানের শীষে বীজ আটকে না থাকে। বীজ বপনের সময় জমিতে যথেষ্ট রস থাকা প্রয়োজন। তবে পানি জমে থাকা চলবে না। পনের দিন পরে সাবধানে ধান কেটে নিলে খেশারি গাছগুলো দ্রুত বাড়তে শুরু করবে। পরবর্তী বোরো ধান চাষের পূর্ব পর্যন- জমিতে খেশারি থাকবে। খেশারি চাষে কোন সেচ, সার বা নিড়ানীর প্রয়োজন হয় না, তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন গরু-ছাগল ফসল নষ্ট না করে।
চাষের সময়:
রিলে ফডার হিসেবে ফডার খেশারি বাংলা কার্তিক বা ইংরেজী নভেম্বর মাসের শেষের দিকে আমন ধানের সাথে চাষ করতে হয়।
ফডার কাটার সময় ও নিয়ম:
পরবর্তী বোরো ধান চাষের জন্য জমি তৈরির পূর্ব মুহূর্তে ফডার খেশারি কাঁচি দ্বারা কেটে উঠাতে হবে। ফডার টেনে উপড়ে তোলা যাবে না। এতে করে শিকড়ে বসবাসকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়া মারা যাবে। খেশারি গাছে যখন ফল আসা শুরু করে তখনই ফডার কাটার উপযুক্ত সময়।
ফলন :
ধানের সাথে রিলে ফসল হিসেবে চাষ করলেও ফডার খেশারির ফলন যথেষ্ট ভাল হয়। একর প্রতি ফলন ৫ থেকে ৬ টন। তুলনা করে দেখা গেছে যে, জমিতে এককভাবে শুধু ফডার খেশারি চাষ করলে যে ফলন হয়, ধানের সাথে রিলে ফসল হিসেবে চাষ করলেও সমপরিমাণ ফলন পাওয়া যায়।
ফডার খেশারির ‘হে’ তৈরির পদ্ধতি:
কাঁচা খেশারি ঘাস, জমি থেকে কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে ‘হে’ তৈরি করা হয়। খেশারি ফডার কেটে তা মাঠে বা বাড়ির আঙ্গিনায় ছড়িয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে শুকাতে হবে। শুকানোর সময় বাঁশের আড়াল দিয়ে দিনে ২/৩ বার উল্টে-পাল্টে দিতে হবে। এতে করে সব ঘাসই সমান তাপ পাবে। এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে ঘাসের মধ্যে শতকরা ১৫ ভাগের বেশি পানি না থাকে। শুকানো সঠিকভাবে হয়েছে কিনা তা বুঝার জন্য এক মুঠো ঘাস হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করতে হবে। যদি পুরোপুরি না ভাঙ্গে অথচ শুকনো মনে হয়, তখনই রোদ্রে শুকানো বন্ধ করতে হবে এবং ‘হে’ তৈরি হয়েছে বুঝতে হবে।
বক্স বেলিং পদ্ধতিতে গাঁইট বাঁধা ও সংরক্ষণ:
তৈরি ‘হে’ গাঁইটে বেঁধে সংরক্ষণের জন্য একটি কাঠের বাক্স তৈরি করতে হবে যার দৈর্ঘ্য ২৫ ইঞ্চি, প্রস্থ ১৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৩ ইঞ্চি হবে। এই বাক্সে চারপাশে চারটি দেয়াল থাকবে, কোন তলা ও ঢাকনা থাকবে না। প্রথমে বাঙ্টিকে সমতল স্থানে বসিয়ে তার মধ্যে দুই প্রান্তের কাছাকাছি স্থানে দুইটি মাঝারি মোটা ৬০ ইঞ্চি লম্বা মাপের রশি বাঙ্রে দৈর্ঘ্যে বরাবর এমনভাবে বিছাতে হবে যাতে রশির দুই প্রান- বাক্সে দুই প্রান্তের পাশ দিয়ে বাইরের দিকে নিচ পর্যন্ত ঝুলে থাকে। এবার ‘হে’ অল্প অল্প করে বাক্সের মধ্যে রাখতে হবে এবং দুই পা দিয়ে চাপ দিতে হবে। বাঙ্ ভরে গেলে দুপাশের রশি ধরে টেনে আঁটি বাধতে হবে। এভাবে প্রস্তুতকৃত আঁটিগুলো ঘরের মধ্যে অল্প স্থানে রাখা যাবে।
বক্সবেলিং পদ্ধতিতে ‘হে’ সংরক্ষণের উপকারিতা : অল্প স্থানে অধিক পরিমাণে ‘হে’ সংরক্ষণ করা যায়, বৃষ্টির পচন থেকে সহজে রক্ষা করা যায়, একস্থান হতে অন্যস্থানে সহজে স্থানান-র করা যায়, সহজে ওজন করা যায় এবং গাভীর প্রয়োজন অনুযায়ী খাওয়ানো যায়।
গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর পদ্ধতি:
ফডার খেশারি তাজা সবুজ অবস্থায় এবং শুকিয়ে ‘হে’ করে রেখে অনেকদিন পর্যন- খড়ের সাথে মিশিয়ে দুধালো গাভী, গরু বা ছাগলকে খাওয়ানো যায়। একটি গাভীকে প্রতিদিন ৩/৪ কেজি সবুজ ফডার খেশারি বা ১.৫/২ কেজি পরিমাণ ‘হে’ খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়। ছাগলের জন্য .৫/১ কেজি ‘হে’ যথেষ্ট।
ফডার খেশারি চাষের উপকারিতা:
১. অধিক পরিমাণে আমিষ, খনিজ ও ভিটামিন যুক্ত গো-খাদ্য পাওয়া যায়।
২. ফডার খেশারি গাভীকে খাওয়ালে দুধের পরিমাণ ২০% বাড়ে।
৩. খেশারির শিকড়ে প্রচুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুটি থাকে। এই সব গুটিতে অসংখ্য অনুজীব থাকে, যারা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।
৪. ফডার খেশারি চাষের পরবর্তী বোরো ধানের ফসল শতকরা ৮ ভাগ বৃদ্ধি পায় এবং একর প্রতি ৩৩৫০ টাকার বোরো ধান বেশি উৎপাদন হয়।
৫. গাভীর খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ শতকরা ২-৪ ভাগ এবং হজম শক্তি ১.৫-২ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
৬. এটি আবাদ করতে সার ও সেচের প্রয়োজন হয় না।
এমন একটি সমন্বিত প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সমপ্রসারণের জন্য এর যথার্থ উপকারিতা এবং ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা একান্ত জরুরি।
মোঃ শাহীন আলম, ময়মনসিংহ বাকৃবি, ময়মনসিংহ
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।