ফুল চাষে সাভারের তিন গ্রামের ভাগ্যবদল
কৃষিকাজের বদলে ফুল চাষকে পেশা হিসেবে নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন সাভারের অনেক কৃষক। সাভারের সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, রাজাসন গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার ফুলচাষের সাথে যুক্ত। এখানে উৎপাদিত গোলাপ, গ্যালোটিলাস ফুলের ওপর নির্ভর করতে হয় শাহবাগের ফুলবাজারসহ দেশের ফুল ব্যবসায়ীদের। দিন দিন এখানকার ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাভারের জমি আশপাশের জমি থেকে উঁচু হওয়ায় ফসলের চেয়ে ফুল চাষ ভালো হয়। ফসলে সময়, শ্রম অনেক বেশি দিতে হয়, সে তুলনায় ফুল চাষে কম সময় লাগে। এজন্য দিন দিন সাভারে ফুল চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে যেখানে তিন বেলার ভাত জোগাতে সবাই ধান চাষ করত, সেখানে এখন তিন বেলা ভাতের পাশাপাশি বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য পেতে চাষিরা বেছে নিচ্ছেন ফুল চাষ।
সাদুল্লাহপুরের কৃষক নূরুল আমিন বাংলানিউজকে বললেন, আগে কৃষিকাজ করতাম কিন্তু লাভ কম। এক পাখি (৩০ শতাংশ) জমিতে ধান হতো ১৫ থেকে ২০ মণ। খরচ পড়ত ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। ধানের দর ভালো না হলে লসও হতো। কিন্তু ফুলচাষে মাত্র একবার বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু এক থেকে দেড় বছরের ভেতর বিনিয়োগের টাকা উঠে আসে। এরপরের ১০ থেকে ১২ বছর শুধু লাভ।
ফুল চাষের আরেকটি সুবিধা, গাছে ফুল ধরার পর প্রতিদিনই কৃষকদের হাতে টাকা আসে। চাষ করার পর শুধু গাছে ফুল আসা পর্যন্তই যা অপেক্ষা। আর মাত্র দেড় বছরের ভেতর বিনিয়োগের টাকা উঠে আসায় অনেকেই এখন ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। মিরপুরের আরমান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমার ১০০ বিঘার ওপর জমিতে ফুল চাষ হয়। নিজের কিছু জমি ছাড়া বাকি জমি লিজে নেওয়া। গোলাপ চাষে জমি লিজ নিতে হয় অন্তত ৫ বছরের আর গ্যালোটিলাস ফুলের জন্য লিজ নিতে হয় ১ বছরের জন্য।
গোলাপ ফুলের পৌনে চারশ জাত আছে। বাংলাদেশে ৬-৭টি জাতের চাষ হয়। এর ভেতর বড় গোলাপ হলো মেরিন্ডা, ছোট সাইজের চাম্পা গোলাপ, গন্ধ বেশি পাপা মিলনে আর দীর্ঘদিন স্থায়ী গোলাপ হল লিংকন। এছাড়া সাদা, লাল, হলুদ রঙের গোলাপ চাষ হয়। সাভারের সাদুল্লাহপুর ও শ্যামপুরের কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে এ গোলাপ চাষ করছেন। তবে রাজাসন গ্রামে অন্য ফুলের চেয়ে গ্যালোটিলাস বেশি চাষ হয়। এখানে সাদা, পিংক, হলুদ, বেগুনি, কমলা, বিস্কুট ও নীল রঙের গ্যালোটিলাসের চাষ হয় বলে জানান আরমান মিয়া। তিনি বলেন, ফুল চাষে বিঘাপ্রতি বছরে টাকা দিতে হয় ৫ হাজার। গোলাপ ফুল চাষে শতকরা ৫০ ভাগ টাকা জমিমালিককে অগ্রিম দিতে হয়। বাকি টাকা এক-দুই কিস্তিতে দিতে হয়।
সারা বছর ফুল চাষ করা হলেও ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে শীত মৌসুমে। প্রতি বছর ভাদ্র (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে গাছের ডাল কাটা হয় আর শীতের আগে গাছে চলে আসে নতুন ফুল। শ্যামপুরের সেলিম মিয়া বলেন, শীতের সময় ফুল চাষে একটা ধড় (প্রচুর ফুল) আসে। এ সময় ফুলের দামও বেশি থাকে। আমরা প্রতিদিন ৫-৬ বান্ডিল (১ বান্ডিলে ৩০০ ফুল) ফুল পাই। অন্য সময় যা ২-৩ বান্ডিলে নেমে আসে।
তিনি আরো বলেন, ফুলের দাম সবচে বেশি থাকে ভ্যালেন্টাইন ডেতে। এ সময় বান্ডিল বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। এরপর পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনসহ বিভিন্ন দিবসেও ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বান্ডিল বিক্রি হয়। তবে অফ সিজনে বান্ডিল বিক্রি হয় ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। এজন্য অনেক কৃষক বিভিন্ন দিবসকে টার্গেট করে ফুলের চাষ বেশি করেন।
বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ এখনো আমাদের বেশ নতুন বিষয়। তাই মাঝে মাঝেই কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হয়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে ফুল চাষকে লাভজনক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব বলে মনে করেন আরমান মিয়া। তিনি বলেন, আমাদের কোনও প্রশিক্ষণ নেই, কাজ করতে করতে শিখেছি। যেসব কৃষি অফিসার এখানে আছেন, তাদের কাছ থেকে ধান চাষের বিষয়ে যত সাহায্য পাওয়া যায় ফুল বিষয়ে তত সাহায্য পাওয়া যায় না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে ফুল চাষে প্রচুর লাভ করার সুযোগ আছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের এখানে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ফুল চাষ হয় না। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ফুল করতে হলে স্টিক বড় করে কাটতে হয়। এতে গাছের ক্ষতি হয়। গ্রিন হাউস শেডে ফুল চাষ করলে স্টিক বড় হয়। ব্যাংক নামমাত্র টাকা আমাদের দেয়। অথচ বড় কোনও বিনিয়োগ ছাড়া শেড তৈরি সম্ভব না। পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে এখানকার ফুল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব বলে মনে করেন ফুলচাষিরা।
লেখক: মো. শরিফুল ইসলাম
এগ্রোবাংলা ডটকম