বৃষ্টি যখন খাওয়ার পানি
সংরক্ষণ: টিনের বেড়া, টিনের ছাউনি দেওয়া পাশাপাশি দুটি ঘর। উত্তর পাশের চালার কিনার বরাবর লম্বা একটি টিনের ডোঙা বাঁধা। ডোঙার এক দিকের প্রান্ত বন্ধ, অন্য প্রান্তে আটকানো একটি বড়সড় চুঙ্গি। নেট দিয়ে মোড়ানো। চুঙ্গি থেকে লম্বা একটি পাইপ এসে ঢুকেছে বাড়ির উঠানে রাখা মুখ বন্ধ ইট-সিমেন্টে তৈরি বাক্সের মধ্যে। বাক্সের নিচের দিকে লাগানো আছে কল (ট্যাপ)। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটি। বৃষ্টি নামলে টিনের চালা দিয়ে গড়িয়ে আসা পানি ওই ডোঙা দিয়ে পড়বে চুঙ্গিতে। সেখানে একদফা ছাঁকার পর পাইপ বেয়ে পানি এসে জমবে মুখ বন্ধ ইট-সিমেন্টের তৈরি ট্যাংকে।
নিচের কল ঘোরালেই পাওয়া যাবে স্বচ্ছ পানি। তবে কলটি যে কেউ ইচ্ছা করলেই ঘোরাতে পারবে না। কারণ, তা আটকে রাখা আছে বিশেষ কায়দায় কাঠ দিয়ে বানানো খাঁচার মতো একটি ফ্রেমের ভেতর। তালা ঝুলিয়ে। অবাঞ্ছিত কেউ যাতে কল না ঘোরায়, সে জন্যই তালা-চাবির এ ব্যবস্থা। সহজ অর্থ। পানি চুরি ঠেকানোর প্রচেষ্টা। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাদুরতলা গ্রামের একরাম আলীর বাড়ির উঠানে এই ট্যাংক বসানো হয়েছে। এই গ্রামের আবদুল মালেক ও সোনা মিয়ার বাড়িতেও আছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই ব্যবস্থা।
পানি চুরির বিষয়টি অনেকের কাছে অভিনব মনে হলেও পাথরঘাটায় এটি এক বাস্তব সমস্যা। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য যাঁদের বাড়িতে এই ব্যবস্থা আছে, সবাই পানি চুরি ঠেকানোর জন্য কল রেখেছেন তালা-চাবি বন্ধ করে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই পদ্ধতির একটি নামও আছে−‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট’। পাথরঘাটা উপজেলার ৭২টি বাড়িতে বসানো হয়েছে এই প্লান্ট। বরগুনা জেলার সংগ্রাম ট্রাস্ট নামের একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এগুলো তৈরি করছে এবং ব্যবহারের নিয়ম শিখিয়েছে।
কেন পানির মতো একটি সহজলভ্য জিনিস লোকে চুরি করতে যাবে, আর কেনই বা বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে এত কায়দা-কৌশল করে−মনে হতেই পারে এমন কথা। সস্তা ও সহজপ্রাপ্যতার উদাহরণ হিসেবে বহুকাল ধরেই আমাদের এখানে পানি তুলনীয় হলেও হালে যে সে অবস্থা আর নেই, বোতল ভরা পানি কিনতে কিনতে তা হয়তো সবাই টের পাচ্ছেন। পাথরঘাটাবাসীর অবস্থা আরও সঙ্গিন। বলতে কি, চারদিকে পানি পরিবেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও পানির অভাবই এ উপজেলার মানুষের সবচেয়ে বেশি। জেলার প্রান্তবর্তী এই উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ছয়টি ইউনিয়ন। জনসংখ্যা এক লাখ ৯২ হাজার (২০০৭ সালের শুমারি)। বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা−তিন নদী দিয়ে ঘেরা সড়ক-যোগাযোগবিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এলাকা। যেতে হয় ইঞ্জিন নৌকায় নদী পেরিয়ে। অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য পাথরঘাটার। মাটির তলায় পাথর আর পাথর। সে কারণেই নাকি পাথরঘাটা নাম হয়েছে! কোত্থেকে যে এত পাথর এল! নলকূপ বসানোর জো নেই। কিছুদূর অবধি পাইপ বসানো হলেই আটকে যায় পাথরে। কালমেঘা, নাচনাপাড়া, কাঠালতলা−এই তিনটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় নলকূপ বাসানোর একেবারেই উপায় নেই। বাদবাকি চরদোয়ানি, রায়হানপুর ও কাকছেড়া ইউনিয়নের কিছু কিছু এলাকায়ও নেহাত ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে কল বসানো যায় না। নদীর পানি লবণাক্ত। সেই আদ্যিকাল থেকেই পাথরঘাটার মানুষের গোসল, রান্নাবানা, ধোয়ামোছা থেকে পানের জন্য পানির উৎস পুকুর। আগে সরাসরিই পুকুরের পানি পান করত তারা। পানিবাহিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তাতে পদে পদে। আক্রান্ত হতোও। ইদানীং বিভিন্ন এনজিও জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করায় তারা পুকুরের পানি ফুটিয়ে পান করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ শতভাগ পুকুরনির্ভর জীবনযাত্রা।
অন্তত পানের পানির ক্ষেত্রে পুকুরনির্ভরতা কমিয়ে আনতেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এখানে। বৃষ্টির পানি সুপেয়। ধরে রাখার কৌশলটিও এমন জটিল কিছু নয়। পাইপ দিয়ে বৃষ্টির পানি বাক্সের মতো যে আধারটিতে জমা হয়, তার ভেতরে আছে তিনটি খোপ। প্রথমে পানি আসে বালি ভরা খোপে। সেখান থেকে যায় কাঁকর ভরা খোপে। সেখান থেকে বিশুদ্ধ পানি জমা হয় বড় একটি খোপে। ট্যাংকগুলোতে পানি ধরে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ২০০ লিটার। বছরে দুইবার ট্যাংকের ওপরের মুখ খুলে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। সংগ্রামের প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী মোনায়েম খান বলেন, ‘পুকুরের পানি ফুটিয়ে পান করতে আমরা উদ্বুদ্ধ করেছি। জ্বালানি বাঁচাতে আগে লোকে পানি ফোটাত না। তবে রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে তাদের অভ্যাস বদলানোর চেষ্টা করছে। আমরা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার যে ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তা যদি আরও ব্যাপক হারে করা যেত, তাহলে সুপেয় পানির সংকট লাঘব হতো।’
তাঁর কাছেই জানা গেল, পাথরঘাটায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের এই প্রকল্প প্রথম তাঁরা শুরু করেছিলেন ১৯৯৭ সালে এনজিও ফোরামের সহায়তায় যৌথভাবে। দুই বছরে ৩২টি বাড়িতে প্লান্ট বসানো হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় দফায় দাতা সংস্থা ড্যানিডার সহায়তায় ২০০৩-০৫ সালে বসানো হয় আরও ৪০টি প্লান্ট। প্রতিটি প্লান্ট বসাতে খরচ পড়েছিল ৩৫ হাজার টাকার মতো। পুকুরের পানিতে সংসারের কাজকর্ম চলে বটে, কিন্তু সমস্যা হয় কোনো কারণে পানি নষ্ট হয়ে গেলে। যেমন−এবার আইলার জলোচ্ছ্বাসে এলাকার পুকুরগুলো ভরে গেছে লোনা পানিতে। সুপেয় পানির এমন কষ্ট সম্ভবত উপদ্রুত অঞ্চলে অন্য কোথাও নেই।
এত সংকটেও যাদের বাড়িতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে, তারাই শুধু রেহাই পেয়েছে খানিকটা। বাদুরতলা গ্রামের একরাম আলীর বাড়িতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই ট্যাংক বসানো হয়েছে ২০০৪ সালে। তিনি বলেন, ‘এইয়া থাকায় এইবারে বইন্যায় আমার খাওয়ার পানির সমস্যা হইতাছে না। সারা বছর পানির লাইগ্যা মিন্নত কইম্যা গেছে।’
চারদিকে থইথই পানি, অথচ পানের পানির অভাবে দিন কাটে উপকূলের মানুষের।
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।