চীনা বাঁধাকপির চাষ
বাঁধাকপির চাষ এ দেশে বহু দিন ধরে হচ্ছে। সে জন্য এটা এখন আমাদের ঘরোয়া সবজি। কিন্তু চীনা বাঁধাকপি? এটা আবার কী? এটাও এক জাতের বাঁধাকপি। তবে আমাদের চিরপরিচিত বাঁধাকপির চেয়ে এটা বেশি সুস্বাদু, কোমল, পুষ্টিকর, সহজপাচ্য এবং দ্রুত বর্ধনশীল। কয়েক দিন আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে চাষ করা পাঁচ রকম চীনা বাঁধাকপি দেখে বেশ ভালোই লাগল। বুঝলাম চীনা বাঁধাকপি এখন এ দেশেই চাষ করা সম্ভব। রান্নার পর খেয়ে আরো ভালোভাবে বুঝলাম, বাঁধাকপির মতো দেখতে হলেও আসলে স্বাদে হুবহু বাঁধাকপির মতো নয়। গন্ধে বাঁধাকপি, স্বাদেও খানিকটা তা-ই, তবে এত নরম ও রসালো যে ওকে শাকের সাথে তুলনা করা যায়। সেখানকার উদ্যানতত্ত্ববিদ মো: মোফাজ্জল হোসেন জানালেন, একসময় এ দেশে বাটিশাকের প্রবর্তন হয়েছিল। চীনা বাঁধাকপি অনেকটা সেই বাটিশাকের মতো। তবে গড়নটা বাঁধাকপির মতো। জনৈক মোশাররফ হোসেন কোরিয়ার একটি বীজ কোম্পানি এশিয়া সিডস থেকে পাঁচটি বীজ পেয়েছিলেন পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করার জন্য। পাঁচটি জাতই গত অক্টোবরে চারা তৈরির জন্য বীজ ফেলা হয়। সবগুলো জাতই ছিল হাইব্রিড। জাত পাঁচটির নাম হলোন্ধ এশিয়া গাউল গিম জ্যাগ, হুই মো রি, জ্যাং সেং, বিউটি ও গা ইন।
মাসখানেক বয়স হলে গত ৮ নভেম্বর সেসব চারা মূল জমিতে রোপণ করা হয়। দু’টি বেডের প্রতিটিতে ৩২টি করে চারা দুই লাইনে বাঁধাকপির মতোই লাগানো হয়। পাশাপাশি অন্য বেডে পাঁচটি হাইব্রিড বাঁধাকপির জাতও তুলনা করার জন্য লাগানো হয়। বাঁধাকপি যখন সবে মাথা বাঁধতে শুরু করেছে তখন চীনা বাঁধাকপি তোলা শুরু হয়। চারা রোপণের ঠিক দুই মাসের মাথায় তোলা শুরু হয় এবং তোলা চলতে থাকে দুই সপ্তাহ ধরে। জাতভেদে এক-একটা চীনা বাঁধাকপির ওজন দেড় থেকে দুই কেজি। সে হিসাবে একটি বেডের ৬৪টি চীনা বাঁধাকপির ফলন হয় প্রায় ১০০ থেকে ১২০ কেজি। অথচ এর জন্য জমি ছিল মাত্র ২০ বর্গমিটার বা আধা শতক। সে হিসাবে চীনা বাঁধাকপির হেক্টর প্রতি ফলন ৫০ থেকে ৬০ টন। প্রচলিত যেকোনো জাতের বাঁধাকপির তুলনায় এটা বেশি। যারা নিত্য বৈচিত্র্যসìধানী, তারা বাঁধাকপির জমিতে বাঁধাকপির বদলে চীনা বাঁধাকপি লাগিয়ে অনায়াসে বেশি লাভ করতে পারেন। তবে উদ্যানতত্ত্ববিদ মোফাজ্জল সাহেব বললেন, অল্প জমিতে লাগিয়ে এবার পরীক্ষা করে ভালো ফল পাওয়া গেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণও ছিল না। কিন্তু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষে এখনো ঝুঁকি আছে। কেননা আমরা বাঁধাকপি খেতে অভ্যস্ত, চীনা বাঁধাকপি খাওয়ার অভ্যেস নেই। সে জন্য বাজারে ভালো দাম পাওয়া অনিশ্চিত। বাণিজ্যিকভাবে চাষের আগে অল্প অল্প করে চাষের মাধ্যমে চীনা বাঁধাকপিকে এ দেশে পরিচিত করতে হবে।
উপযোগী মাটি ও আবহাওয়া : চীন দেশে উৎপত্তি বলে নাম চীনা বাঁধাকপি। চীন, কোরিয়া ও জাপানে চীনা বাঁধাকপি ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। চীনের উত্তরাঞ্চলে মোট সবজির প্রায় ২৫ শতাংশই চীনা বাঁধাকপি। উৎপাদনের দিক দিয়ে জাপানে মুলা ও বাঁধাকপির পরই এর স্খান। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই চীনা বাঁধাকপির চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। স্বল্প জীবনকালের জন্য বাঁধাকপির তুলনায় দিন দিন চীনা বাঁধাকপি চাষিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চাষের জন্য বাঁধাকপির মতোই জমি ও আবহাওয়ার দরকার হয়। মধ্যম শীতে ভালো হয়। চীনা বাঁধাকপির ভালো বাড়বাড়তির জন্য ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উত্তম।
জাত : আদি ফসল বলে এর জাতের সংখ্যা অগণিত। সব জাতকে বিজ্ঞানীরা চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো ঢিলা পাতাবিশিষ্ট জাত, অল্প মাথাবাঁধা জাত, মাথা ফোলা বা ফাঁপা জাত এবং বাঁধাকপির মতো মাথা বাঁধা জাত। চীনা বাঁধাকপির মাথা ঠিক একটু লম্বাটে ও নরম। পাতা বেশ রসালো ও হালকা সবুজ, মখমলের মতো মোলায়েম। কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে যে পাঁচটি জাত এবার চাষ করা হয় সেগুলোর মধ্যে এশিয়া গাউল গিম জ্যাগ, হুই মো রি ও জ্যাং সেং জাত তিনটি ছিল অল্পমাথা বাঁধা স্বভাবের। বিউটি ও গা ইন জাত দু’টির মাথাই বাঁধে না, ওগুলো ছিল মাথা ফোলা বা ফাঁপা জাত, মাথায় পাতাগুলো ছিল ছড়ানো। গা ইন জাতটি ছিল গাঢ় সবুজ রঙের, অন্য সব জাতের রঙ ছিল হালকা সবুজ।
চাষাবাদ : উঁচু বেডে বীজ বুনে চারা তৈরি করতে হয়। চারার বয়স চার সপ্তাহ হলেই তা মূল জমিতে রোপণের উপযুক্ত হয়। অক্টোবর মাস চারা তৈরির উত্তম সময়। রোপণের জন্য ভালো নভেম্বরের প্রথম অর্ধেক। ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে সারি করে চারা রোপণ করতে হয়। এ সময় লাগালে জানুয়ারির প্রথম দিকেই ফসল তোলা যায়। চীনা বাঁধাকপির পরিচর্যা বাঁধাকপি-ফুলকপির মতোই। বিশেষ কোনো যত্নের দরকার হয় না। ভালো বাড়বাড়তির জন্য জৈব ও রাসায়নিক সার দিতে হয়। হেক্টরপ্রতি সুপারিশকৃত সারের মাত্রা হলো ইউরিয়া ৪৩৫ থেকে ৪৫০ কেজি, এমওপি ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি, টিএসপি ৫০০ থেকে ৭০০ কেজি এবং ৫০ থেকে ১০০ কেজি ম্যাগনেসিয়াম সালফেট। হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ১০ টন জৈবসার জমি চাষের সময় মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হয়। সেই সাথে পুরো এমওপি এবং টিএসপি।
ইউরিয়া সার চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন পর থেকে দুই কিস্তিতে সমান ভাগ করে দিয়ে সেচ দিতে হয়। চাষাবাদের সমস্যা : তেমন কোনো রোগ ও পোকার আক্রমণ না হলেও পাতার মাথা শুকাতে দেখা যায়। এ লক্ষণকে বলে টিপবার্ন। ধীরে ধীরে পাতার কিনারা থেকে বাদামি হয়ে শুকাতে শুরু করে। ক্যালসিয়ামের অভাব হলে এরূপ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে জমি চাষের সময় মাটিতে শতকে ১ থেকে ২ কেজি চুন প্রয়োগ করলে পরে আর এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অনেক সময় বোরনের অভাবও দেখা যায়। মাটিতে বোরনের অভাব হলে পাতার পুরু ও রসালো মধ্যশিরার ভেতরের দিকে ফেটে যায় ও সেখানটা বাদামি হয়ে যায়। পরে বর্ধনশীল বিন্দুটি পুড়ে যায়। ফলে আর মাথা বাঁধতে পারে না। মাথা বাঁধার সময় এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। এরূপ লক্ষণ শুরু হলে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক পাউডার গুলে পাতায় স্প্রে করে দিতে হবে। এ ছাড়া বেশি ইউরিয়া সারের প্রয়োগও অনেক সময় বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এর ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায়। মাথা বাঁধার সময় লাইনের মধ্যে ইউরিয়া সার দিলে এরূপ সমস্যা হতে পারে। এ সময় ইউরিয়ার আধিক্যে মাথার ভেতরের দিকের পাতার মধ্যশিরার ওপরে কালো কালো দাগ পড়ে। সেসব পাতা থেকেই বিকৃতি শুরু হয়।
ফসল তোলা ও ফলন : গোড়া থেকে কেটে পুরো মাথাটাই তোলা হয়। গোড়া থেকে ঝুলে পড়া আলগা পাতা ছেঁটে ফেলে দিয়ে মাথাটাই বিক্রির জন্য বাজারে পাঠানো হয়। হেক্টর প্রতি গড় ফলন পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ টন। তবে এখন অনেক হাইব্রিড জাত বাজারে আসায় ফলন ২০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি পাওয়া সম্ভব।
সংরক্ষণ : ক্ষেত থেকে তোলার পর পরই চীনা বাঁধাকপি রস হারাতে থাকে। এতে ওজন কমে যায় ও শুকিয়ে নেতিয়ে আসতে থাকে। ক্ষেত থেকে তোলার পর যত দ্রুত সম্ভব তা খেয়ে ফেলতে হবে বা বিক্রির ব্যবস্খা করতে হবে। তবে হিমাগারে বা ফিন্সজে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় অনেক দিন রাখা যায়।
চাষের সম্ভাবনা : চীনা বাঁধাকপির চাষ কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারেই প্রথম নয়। আগেও এ বিষয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে এ দেশের মাটিতে এটা চাষ সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিদেশে চীনা বাঁধাকপির অনেক জাত রয়েছে। এখন শুধু সেসব জাত থেকে বাছাই করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অধিক ফলনশীল ও লাভজনক কিছু জাতের চাষ সম্প্রসারণ প্রয়োজন। আগ্রহী প্রতিষ্ঠান, খামার ও উৎসাহী সবজিচাষিরা এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।