মরিচ

জুমে মরিচ চাষ

ভাবতে অবাক লাগে, ৪০০-৫০০ বছর আগেও যে দেশের মানুষ মরিচ চিনতেন না, ঝাল বুঝতেন না তারা কী করে এত ঝালপ্রিয় জাতিতে পরিণত হলো। আসলে ওটা শিখিয়েছে পর্তুগিজরা। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তারা দক্ষিণ আমেরিকার মরিচ নামক বস্তুটি ভারতবর্ষে নিয়ে আসে এবং তার ব্যবহার ও আবাদ শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে মরিচ ভারতবাসীর কাছে রান্নার প্রধান মসলা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডিসি ছিলেন ক্যাপটেন টি এইচ লুইন। তিনি ১৮৬৯ সালে তার লেখা একটা বই ‘The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein’ প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, জুমে মরিচ হয়, এপ্রিলে সেসব মরিচের বীজ বোনা হয় ও অক্টোবরে মরিচ তোলা শেষ হয়। সেই মরিচ সাধারণত বাজারে বিক্রি হয় না। আর বিক্রি হলেও দাম টাকায় আট সের। আধা পোয়া বীজ বুনলে ২০-২৫ সের মরিচ পাওয়া যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য আদা, হলুদ, কার্পাস তুলা, তিল, কচু, কাসাভা, ভুট্টা, মরিচ, ফল প্রভৃতি। প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য জুম চাষ থেকেই পাওয়া যায়। পাহাড়ে জুমে যে মরিচ উৎপাদন হয়, তা স্থানীয়দের কাছে ‘জুম মরিচ’ নামে পরিচিত। জুম মরিচ চাষ প্রধানত পাহাড়ি জনগণের সারা বছরের মরিচের চাহিদা পূরণ করে। তবে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদে ফলন কম হয়। আধুনিক পদ্ধতির সমন্বয় ঘটিয়ে জুমে আশাব্যঞ্জক ফলন পাওয়া যেতে পারে।

জুম মরিচের বৈশিষ্ট্য : জুম মরিচের গাছ দ্বিবর্ষজীবী অর্থাৎ দুই বছর বাঁচে। সারা বছর মরিচ ধরে, তবে শুধু চৈত্র মাসে খুব কম মরিচ ধরে বা ধরে না। গাছ প্রায় ১-১.৫ মিটার লম্বা ও ঝোপালো। পাতা বড় ও সুপ্রশস্ত। মরিচ ঊর্ধ্বমুখী বা খাড়াভাবে জন্মে। মরিচের রঙ সাদা বা হালকা সবুজ, পাকলে হয় কমলা লাল।

জাত: সূর্যমুখী, ধানি ও স্থানীয় উন্নত জাত। ধানি মরিচ খুব ছোট আকারের ও ঝালও বেশি। গাছে মরিচ ধরেও বেশি। এ ধরনের মরিচ সাধারণত চাষ বা বপন করা হয় না, জঙ্গলে আপনাআপনি জন্মে। দেখতে খুবই ছোট। পাহাড়িদের কাছে এ মরিচ খুবই জনপ্রিয়। বীজ বপনের সময়: দুই মওসুমে জুম মরিচের চাষ করা হয়। রবি বা শীত মওসুমে মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসে বীজ বপন করা হয়। খরিপ মওসুম বা গরমকালে বীজ বোনা হয় মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য বৈশাখের (মার্চ-এপ্রিল) মধ্যে।

বীজ বপন: দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে সেখানে সরাসরি অন্যান্য ফসলের বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ বোনা হয়। প্রতি হেক্টরে প্রায় এক কেজি বীজ বোনা হয়। অনেকে জুমে অন্যান্য ফসলের বীজ বোনার সময় মরিচের বীজ জুমে ছিটিয়ে দেন।

জমি প্রস্তুত ও চারা রোপণ: সম্প্রতি কেউ কেউ বীজতলায় জুম মরিচের চারা তৈরি করে সেসব চারা রোপণ করছেন। চারা তৈরি করে লাগাতে চাইলে হেক্টরে ৫০০-৬০০ গ্রাম বীজ লাগে। মাসখানেকের চারা ৬০ সেন্টিমিটার পরপর সারি করে প্রতি সারিতে ৩০ সেন্টিমিটার পরপর একটি করে চারা রোপণ করা যেতে পারে। সল্ট বা কন্টুর পদ্ধতিতে চাষ করলে আড়াআড়িভাবে পাহাড়ের এক ফালিজমিতে শুধু জুম মরিচের চাষ করা যেতে পারে। এক ফালি জমি ৪-৬ মিটার চওড়া হতে পারে। এই জমি ফালির দুই পাশে তখন অবশ্যই ভূমি ক্ষয় ঠেকানোর জন্য দুই সারি শিমজাতীয় গাছ (ডুমুশিম বা অড়হর, বকফুল, ধৈঞ্চা প্রভৃতি) লাগিয়ে স্থায়ী বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। দুই বেষ্টনীর মাঝের জমি ফালি চষে সেখানে জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে আধুনিক নিয়মে সারি করে জুম মরিচের চারা রোপণ করতে পারলে প্রচলিত জুম মরিচ চাষের চেয়ে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যাবে। সেসব জুম মরিচের জমির পরিচর্যার কাজও সহজ হবে।

পরিচর্যা: বীজ বুনে জুম মরিচ চাষে অন্যান্য জুম ফসলের মতোই পরিচর্যা অর্থাৎ কেবল আগাছা পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু সল্ট পদ্ধতিতে চারা রোপণ করে চাষ করলে সেখানে আগাছা পরিষ্কার ও সার দিতে হয়। তেমন কোনো রোগ ও পোকার আক্রমণ হয় না। মরিচ পাকার সময় হলে মাঝে মধ্যে অ্যানথ্রাকনোজ বা পাতা ও ফলে বাদামি রঙের শুকনো ক্ষত রোগ দেখা দেয়। এ রোগ বেশি হলে যেকোনো অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (যেমন ডায়থেন এম ৪৫) স্প্রে করে দিলেই চলে। মরিচ ছিদ্রকারী লেদা পোকার আক্রমণ দেখা দিলে আক্রান্ত মরিচ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

ফলন: বোনা জুম মরিচের ফলন বেশ কম, হেক্টরে ৪-৬ টন কাঁচা ও ১-১.৫ টন শুকনো মরিচ পাওয়া যায়। কিন্তু রোপা মরিচের ফলন বেশি।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম