সরিষা চাষ
বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের প্রায় ৬০ ভাগ আসে সরিষার তেল থেকে এবং এটিই আমাদের ভোজ্যতেলের প্রধান ফসল। বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৩৮-৪৪% তেল থাকে আর বাকিটা খৈল ২৫% ও ৪০% আমিষ। এই খৈল গৃহপালিত পশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে প্রতি হেক্টরে সরিষার ফলন হয় ৬০০- ৭২৫ কেজি। দেশের অঞ্চল ভেদে ফলন বেশি ও কম হতে পারে। বাংলাদেশের তেল বীজ উৎপাদনের অধীনে জমির পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর। অথচ তেল বীজ চাষের উপযোগী জমির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। সম্ভাব্য গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১.৫ থেকে ২.০ টন। বাংলাদেশের অঞ্চল ভেদে এখন বা সময় অনুযায়ী রোপা আমন বা বোনা আমন ফসল তুলে ফেলার পর করা যায় সরিষার চাষ।
বিনা সরিষার জাত সফল ও অগ্রণী জাতের ফলন সর্বোচ্চ হেক্টর প্রতি ২.৪ থেকে ২.৭ টন। প্রচলিত অন্যান্য জাতের তুলনায় সফল ও অগ্রণীর গাছ মোটা ও শক্ত। গাছ সহজে মাটিতে ঢলে পড়ে না। অল্টারনারিয়া রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন।
চাষ পদ্ধতি
জমি ও মাটি : এঁটেল দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং দো-অঁশা মাটিতে সফল ও অগ্রণী জাতের সরিষা ভালো হয়। তবে এ জমিতে পানি সরানোর সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
বীজ বপনের সময় : অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ বপন করতে হবে। তবে নভেম্বরের ১৫ তারিখ পযর্ন্ত বপন করা যায়।
জমি তৈরি : জমিতে জো আসার পর মাটির প্রকারভেদে ৪- ৬টি চাষ ও মই দিয়ে বীজ বপন করতে হয়। মাটিতে রসের অভাব হলে বীজ বপনের আগে হালকা সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগ : হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ ছকে দেয়া হলো। এতে ফলন ২৫০০ পযর্ন্ত পাওয়া যেতে পারে। সার প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে পরিচর্যাও করতে হবে।
সারের নাম সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর)
উইরিয়া……………………………………………………২৬৫-২৮০ কেজি
টিএসপি…………………………………………………. ১৭৫-১৮০ কেজি
মিউরেট অব পটাস……………………………………….. ৫০-৬৫ কেজি
জিপসাম…………………………………………. …….. ২৫০-২৯০ কেজি
সরিষার জমিতে সালফার (জিপসাম) প্রয়োগ উৎপাদন ৪০% পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
সার প্রয়োগ ও সেচ অনুক্রম কেজি/হেক্টর
জমি তৈরি ৫-৪০ দিন সময় ৪০-৬০
সারের নাম সার প্রয়োগের সময়
জৈব সার সম্পূর্ণ পরিমাণ
ইউরিয়া ১৩৫ ১৩৫
টিএসপি সম্পূর্ণ পরিমাণ
এমপি সম্পূর্ণ পরিমাণ
জিপসাম সম্পূর্ণ পরিমাণ
ঘাটতি দেখা দিলে
বোরাক্স ৫ (স্প্রে) ৫ (স্প্রে)
ডলোচুন ৩০০
মলিবডেনাম ১ (স্প্রে) (স্প্রে)
পানি সেচ প্রথমবার দ্বিতীয়
অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া এবং সব টিএসপি, এমপি ও জিপসাম সার জমি তৈরির সময় মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
বাকি অর্ধেক ইউরিয়া বীজ বপনের ৩৫-৪০ দিন পর যখন চারা গাছে ফুল আসতে শুরু করবে তখন ছিটিয়ে দিতে হবে ।
ভোরবেলা গাছে শিশির থাকে সার ছিটালে গাছের পাতায় লেগে থাকে তাই গাছের পাতা পুড়ে যেতে পারে সে জন্য বিকাল বেলা সার ছিটাতে হবে।
বীজ বপন পদ্বতি ১. বীজ ছিটিয়ে বা সারিতে বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে লাঙ্গল দিয়ে নালা কেটে গর্তে বীজ ফেলে তা মাটি দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে।
২. সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হবে এবং সারিতে ৪-৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখা দরকার।
৩. বীজ ছিটিয়ে বপন করলে ভালোভাবে মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে।
৪. গাছ বেশি ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে।
বীজের পরিমাণ ছিটিয়ে বপন ৭.০- ৮.০ কেজি/ হেক্টর
সারিতে বপন ৪-৬ কেজি/ হেক্টর
জমিতে আগাছা দেখা দিলে বীজ গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
পানি সেচ চারা গজানোর ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলে বীজ বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে একটি এবং তারপর ২০-২৫ দিন পর আরেকটি সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয়।
পোকা দমন বিনা সরিষার বীজ ব্যাভিস্টিন (২.৫ গ্রাম ) বা বেনলেট (১.৫ গ্রাম) দিয়ে শোধন করতে হবে। অল্টারনারিয়া রোগের আক্রমণ বেশি দেখা দিলে ডায়াথেন এম ৪৫ বা রোভরাল স্প্রে করতে হবে। ফুল ধরা শেষ হলে ১৫ দিন পর পর দুবার স্প্রে করলেই হবে।
জাব পোকার আক্রমণ হলে ফলন কমে যায়। ফুলের কুড়ি আসা শুরু করলে এ পোকা আক্রমণ করে। এ ক্ষেত্রে ডাইমেক্রন ১০০ সিসি বা ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রভৃতি কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
পরাগায়নে মৌমাছি মৌমাছি সরিষা গাছের পরাগায়নের সাহায্য করে এবং এতে ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরিষা ফুলে প্রচুর মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য বিচরণ করে।
ফসল সংগ্রহ সরিষা গাছে যখন ফল তথা সিলিকুয়া হলুদ রঙের হলে ফসল তুলতে হবে। মাটি নরম থাকলে গাছের গোড়া ধরে টেনে শিকড়সহ তোলা যায়। অন্যথায় মাটির উপরিভাগের গাছের গোড়া কেটে নিতে হবে। তারপর ভালোভাবে ৪-৫ দিন বীজ রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
লেখক: উত্তম সরকার
এগ্রোবাংলা ডটকম
সরিষা চাষে বোরন সার ব্যবহার
বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিনের পরই সরিষার স্থান। তবে তেল ফসল হিসেবে বাংলাদেশে সরিষার চাষই প্রধান। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়ে থাকে। যা থেকে প্রায় আড়াই লাখ টন সরিষা বীজ উৎপাদন হয়। এর হেক্টর প্রতি গড় ফলন প্রায় ৭৪০ কেজি। যা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আরো বাড়ানো সম্ভব।
এখানে উন্নত পযুক্তি বলতে উফশি জাত ব্যবহার, বপনের সময় ও পরে বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করা এবং সার প্রয়োগের বেলায় সুষম মাত্রা অনুসরণ ও বোরন সার ব্যবহার করা। সরিষা চাষে বোরন সার ব্যবহার করলে ফলন শতকরা ১৯৮-২৩০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এ জন্য হেক্টরপ্রতি মাত্র ১২০-১৫০ টাকা খরচ করে অতিরিক্ত প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
সরিষা বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়। তবে বেলে বা দো-আঁশ মাটিতেও সরিষা হয়। যেহেতু বেলে ধরনের মাটিতে সেচ দেয়ার পর পানি চুইয়ে নিচে চলে যায় এবং এ সময় পানির সঙ্গে বেশ কিছু খাদ্যোপাদানও নিচে চলে যায়। এসবের মধ্যে বোরন অন্যতম।
সরিষা চাষে প্রচুর রোদ, কম তাপমাত্রা ও জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ও মাটিতে রসের অভাব হলে বীজের আকার ছোট হয় ও বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। এজন্য বাংলাদেশে রবি মৌসুমেই সরিষার চাষ করা হয়ে থাকে। মধ্য কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ (প্রথম থেকে মধ্য নভেম্বর) পর্যন্ত সরিষার বপন সময়। সরিষার বীজ ছোট বলে ৪-৬টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হয়। জমিতে যাতে বড় বড় মাটির ঢেলা ও আগাছা না থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। সারিতে ও ছিটিয়ে উভয় পদ্ধতিতেই সরিষার বীজ বপন করা যায়। সারিতে বুনলে, সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. এবং সারিতে বীজ পরপর বপন করে যেতে হয়। কাঠের ছোট লাঙ্গল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা দিয়ে মাটির আড়াই থেকে তিন সেমি. গভীরে বীজ বপন করে তা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। আর ছিটিয়ে বুনলে শেষ চাষের পর বীজ বপন করে মই দিয়ে জমি সমান করে দিতে হয়। সরিষার বীজের সঙ্গে বপনের সুবিধার জন্য ঝুরঝুরে মাটি বা ছাই মিশিয়ে নেয়া যেতে পারে।
সরিষার জমিতে যেন কখনোই রসের অভাব না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। ফুল আসার আগে বা গজানোর ২২-২৫ দিনের সময় প্রথমবার, শুটি হওয়ার সময় বা ৫০-৫৫ দিনে দ্বিতীয়বার এবং শুটির বীজ পুষ্ট হওয়ার সময় বা ৭০-৭৫ দিনে অবশ্যই জমিতে রস থাকা আবশ্যক, অর্থাৎ প্রয়োজনে সেচ দেয়া উচিত। সরিষার জমিতে সাধারণত প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়, তবে জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। সেচের পর জো আসার সঙ্গে সঙ্গে নিড়ানি দিয়ে মাটির চটা ভেঙে আলগা করে দিতে হয়। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর প্রথমবার এবং ১৮-২০ দিন পর দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিয়ে অতিরিক্ত চারা ও আগাছা তুলে ফেলতে হয়।
জাত, মাটি, স্থান (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল) ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সরিষার জমিতে সার ব্যবহারের তারতম্য হতে পারে। একর প্রতি ইউরিয়া ৬৮-৭২ কেজি, টিএসপি ৫৪-৫৫ কেজি, এমওপি ২৫-৩০ কেজি, জিপসাম ৯০-৯৫ কেজি, জিংক অক্সাইড ০-২ কেজি এবং বোরন (বোরিক এসিড) ১-১.৫ কেজি। বোরন সার হিসেবে পানিতে গুলে নিয়ে স্প্রে করতে হয়। পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে নির্ধারিত মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ সার প্রয়োজন হয়। এ জন্য ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার বোরন সার স্প্রে করা যেতে পারে। জমিতে সরাসরি বোরন সার প্রয়োগ করা যায়। সেক্ষেত্রে টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক অক্সাইড ও বোরন সারের সবটুকু এবং ইউরিয়ার অর্ধেক পরিমাণ শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হয়। বাকি ইউরিয়া গাছে ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করে একবার পানি সেচ দিতে হয়। সরিষা চাষে বোরন সার ঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে সরিষার দানা বড় ও বেশি হয় এবং ফলনও বাড়ে।
এগ্রোবাংলা