বনসাই

বনসাই শিল্পের আদ্যপ্রান্ত

বনসাই এর পারিভাষিক অর্থ জীবন্ত ভাস্কর্য৷
বনসাই এর ইতিহাস বহু পুরানো ।ধারণা করা হয় প্রায় ২০০০ বৎসর পূর্বে চীনে এর শুরু হয় এবং পরবর্তীতে চীনের অন্যান্য অঞ্চল, জাপান, কোরিয়া ও ভিয়েতনামে বিস্তৃতি লাভ করে । বাংলাদেশেও এখন উন্নত মানের বনসাই কালচার চালু রয়েছে এখন এসব বিদেশেও যায় ৷

বনসাই বলতে বুঝায় বৃক্ষ জাতীয় গাছকে (ফলজ ও বনজ) তার আকৃতি ঠিক রেখে সেগুলোর নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন প্রকার টবে ধারণ করা৷ বনসাই চাষের মাধ্যমে অল্প পরিসরে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা যায়৷ এর মাধ্যমে আনন্দ খোজাই বনসাই কালচারের উদ্দেশ্য।

বিভিন্ন ধরনের বনসাই রয়েছে৷ ব্রুম, রুটওভার রক, ফরমাল, ইনফরমাল, রুট অ্যাক্সপোজ, ইনফরমাল আব্রাইট, টুইনট্রাংক, টৃপলট্রাংক, মাল্টিট্রাংক, ফরেস্ট, ডেপ্টউড, ল্যান্ডস্ক্যাপ, প্লানটিং, লিটারেটি ইত্যাদি৷

বনসাই
এসবের মধ্যে ব্রুম জাতীয় বনসাইগুলো অনেকটা ছাতার মতো দেখতে৷ রুটওভার রকগুলো সাধারণত টবে রাখা পাথরের ওপর বৃক্ষমূলের সুন্দর প্রকাশ৷ আর রুটগুলো (বৃক্ষমূল) যখন পাথরে আবৃত না হয়ে টবে রাখা মাটির ওপর ছড়িয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে তখন সেটা হবে রুট অ্যাক্সপোজ জাতীয় বনসাই৷ফরমাল বনসাইয়ের ক্ষেত্রে ডালপালাগুলোর নিয়মিত শয্যাবিন্যাস দেখা যায়৷ যেটা ইনফরমাল বনসাইয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় না৷ ডালপালাগুলো এলোমেলো হয়৷ ইনফরমাল আব্রাইট জাতীয় ইনফরমাল বনসাইয়ের মতো৷ তবে তা হেলানো ঝুলানো অবস্থায় থাকে৷

বৃক্ষের দুটি কাণ্ড বনসাইয়ের সৃষ্টি করলে টুইনট্রাংক, তিনটি কাণ্ড মিলে করলে টৃপলট্রাংক ও তিনের অধিক কাণ্ড হলে মাল্টিট্রাংক জাতীয় বনসাই হবে৷ বিভিন্ন প্রজাতির বনসাইকে মূলত তিনটি শেপ দেয়া হয়৷ এগুলো স্মল শেপ যা ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়, মিডিয়াম শেপ যা ১০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার এবং লার্জ শেপ ২৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে৷
বনসাই
এটা একটি জটিল ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া আসুন দেখি কিভাবে বনসাই তৈরী করতে হয়।

চারা তৈরি : সাধারণত বনসাইয়ের চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে হয়। বীজ সংগ্রহ করেও চারা তৈরি করে নিতে পারেন। যেসব প্রজাতির বীজ পাওয়া যায় না, সেসব উদ্ভিদের অঙ্গজ পদ্ধতি অবলম্বন করে চারা তৈরি করতে হয়। বীজ সংগ্রহ করেও চারা তৈরি করে নিতে পারেন। অর্থাৎ কাটিং, ঝড় বিভাজন, তেউড় বিভাজন, দাবা কলম, গুটি কলম, চোখ কলম প্রভৃতি পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে চারা তৈরি করে নিতে হয়। টব বাছাই ক্যাসকেটড বা উঁচু বনসাই ছাড়া সবরকম বনসাইয়ের জন্য ছোট বাটির টব উত্তম। টবের আকার হওয়া উচিত গাছের শাখা-প্রশাখাসহ তার বিস্তারের চেয়ে কিছুটা ছোট। আকৃতি দৃষ্টিনন্দন হওয়া চাই। টবের আকৃতি সবসময় বৃত্তাকার হতে হবে এমন নয়, আয়তাকার, বর্গাকার কিংবা ত্রিভুজাকারও হতে পারে।

টবে সার মাটি প্রয়োগ : প্রথমে বিভিন্ন জাতের বনসাইয়ের জন্য আলাদাভাবে মাটি তৈরি করতে হয় ৷ মাটি তৈরির ক্ষেত্রে জৈব সারের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে৷ সব ক্ষেত্রেই দোআশ বা পলি মাটি ব্যবহার করা হয়৷ বনসাই টবের জন্য মাটি তৈরি করা খুব সহজ। প্রধানত দোআঁশ মাটির সঙ্গে জৈবসার মিশিয়ে বনসাইয়ের মাটি তৈরি করা হয় নিম্নোক্তভাবে :
দোআঁশ মাটি :পরিমাণমতো, কম্পোস্ট- ১/২ কেজি হাড় গুঁড়ো ৫০ গ্রাম, খড়ি মাটি গুঁড়ো ৫০ গ্রাম, ইট গুঁড়ো ১৩০ গ্রাম, কাঠের ছাই ৭৫গ্রাম ।

চারা লাগানো- কাটিং গুটি কলম বা বীজের চারা বনসাইয়ে সার-মাটি ভরে যথারীতি লাগাতে হবে। টবে জল নিষ্কাশনের ছিদ্রের ওপর ইটের কুচির পরিবর্তে এক টুকরো তারের জালি রেখে তা কিছু কাঁকর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর যথারীতি সার-মাটি ভরে চারা লাগাতে হবে।

বনসাই তৈরির ধাপ : বনসাই তৈরির জন্য কাণ্ড, শেকড়, শাখা-প্রশাখা ও পাতার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাই যথেষ্ট নয়। টবের ছোট গাছে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা বয়োবৃদ্ধ গাছের সুঠাম ভঙ্গিমায় আনার চেষ্টা করতে হবে।

ধাপসমূহ : কুঁড়িভাঙা চারাকে অতিমাত্রায় বেঁটে করে রাখতে ও ঝোঁপালো করতে কুঁড়ি বা পত্রমুকুল ভেঙে দিতে হয়। ক্ষুদে বনসাইয়ের বেলায় তা করতে হয় বা নিরস্তর। কারণ, সবসময় বাড়ন্ত ডগা মাত্র দু’টি পাতা রেখে কেটে দিতে হবে। কুঁড়িভাঙার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নিচের পাতার কাঙ্ক্ষিতকুলকে বাড়তে বাধ্য করা। কারণ ওগুলো বাড়লে গাছের শাখার সংখ্যা বেড়ে গাছ ঝোঁপালো হবে।

শাখা বাছাই : বনসাইকে যে মডেলের রূপ দেয়া হবে তা স্থির করে শাখা বাছাই করা দরকার। জোড়া পাতার কক্ষ থেকে কান্ডের দু’পাশে দু’টি শাখা গজায়। বাছাই পদ্ধতি অনুসারে এর একটিকে রাখতে হবে। নিচেরটি ডানদিকে রাখলে তার ওপরেরটি বামদিকে রাখতে হবে। আসলে বনসাইয়ের কাণ্ডের রূপ সামনের দিকে কোন শাখা থাকবে না। থাকবে কেবল ডান ও বাম দিকে এবং পেছনে কাণ্ডের মাথার দিকেও শাখা থাকতে হবে।

শাখা ছাঁটাই : প্রায়শই বনসাইয়ের বয়স ৩-৪ বছর হলে তখন প্রুনিংয়ের প্রয়োজন হয়। বাছাই করা মোটা শাখাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটতে হয়। এর জন্য যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা উচিত তার নাম কনকেভ কাটিং প্লায়ারস এর কাটার ধরন পৃথক। কাটার স্থানের চারদিক থেকে ছাল বেড়ে তাড়াতাড়ি তা ঢেকে দেয়। বন সাই পরিচর্যার জন্য স্পেশাল যন্ত্রপাতি পাওয়া যায শুধুমাত্র সেই গুলিই ব্যবহার করুন।

তার বাঁধা : কাণ্ড বা শাখাকে সুন্দর, সুঠাম ভঙ্গিমায় আনতে যেসব কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা হয় তার বাঁধা তাদের মধ্যে অন্যতম। সরল শাখায় তার জড়িয়ে আঁকাবাঁকা রূপ দেয়া যায়। কাণ্ডের জন্য মোটা তার ও শাখার জন্য সরু তার প্রয়োজন। সাধারণত এজন্য তামার তার ব্যবহার করা হয়। অনেকে গ্যালভানাইজিংয়ের তারও ব্যবহার করেন। মনে রাখা দরকার, তার জড়ানোর ফলে গাছ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তার খোলার পর গাছকে ছায়ায় বা হালকা ছায়ায় অন্তত সপ্তাহখানেক রাখা দরকার। প্রয়োজন বোধে দু’তিনবার তার জড়ানো যেতে পারে; কিন্তু তা অন্তত ছয় মাস অন্তর হওয়া দরকার। বনসাই তৈরির জন্য উপযুক্ত প্রজাতির গাছ যেমন বট, পাকু, হিজল, অশ্বথ, ডুমুর, ডালিম, কদম, বাগানবিলাস, বোতল ব্রাশ, নিম, জামরুল ও তেঁতুল ইত্যাদি।

একটা সাধারণ ধারণা আছে, বনসাই বিশেষ এক ধরনের গাছ৷ এ কথা সত্য, বিশেষ কয়েক ধরনের গাছকে সহজেই বনসাই করা যায়৷ তবে তার মানে এই নয়, বনসাই আলাদা কোনো প্রজাতির গাছ৷ ছোট পাতা-ফুল-ফল হয় এমন যেকোনো ধরনের বৃক্ষকে বনসাইয়ে রূপ দেওয়া যায়৷ যেমন- বট বা পাকুড় গাছের পাতা আকারে খুব বড়ও নয়, ফল হয় ছোট, আবার এ গাছ দীর্ঘায়ু এবং অনেক বড়ও হয়, তাই সহজে একে বনসাই করা যায়৷ কিন্তু রাবার গাছের পাতার আকৃতি অত্যধিক বড় হওয়ায় একে বনসাই করা যায় না৷ মনে রাখতে হবে, ছোট্ট একটি টবে বড় একটি গাছের ক্ষুদ্র সংস্করণই বনসাই৷ আবার এও মনে রাখা দরকার যে টব এবং গাছের সুসমন্বয় না হলে সার্থক বনসাই সৃষ্টি হয় না৷ বনসাই চর্চা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন অনেক নতুন নতুন স্থানীয় গাছ বনসাই হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে৷ আমাদের বাংলাদেশে বট, আমলকী, তেঁতুল, করমচা সার্থক বনসাই হওয়ায় যুগ যুগ ধরে এসব গাছকে বামন করার নানা কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে৷ কখনো গাছের সঙ্গে তার ডাল-পাতাকেও মানানসই করতে ছোট আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে৷ বনসাই এক জীবন্ত ভাস্কর্য৷ ধ্রুপদী জাপানি বনসাইয়ের নির্দিষ্ট কিছু আকৃতি রয়েছে৷ কিন্তু কোনো শিল্পকলাই যেমন নিয়মের কঠোর ঘেরাটোপে বন্দি নয়, তেমনি বনসাইও ধরাবাঁধা ছাদে বন্দি নয়৷ বহু বনসাই আছে, যা নিয়ম অমান্য করেই অপরূপ হয়ে উঠেছে৷ যে বনসাই দেখতে ভালো লাগে, মনকে আনন্দ দেয় তাকেই সার্থক বনসাই বলা যায়৷ তবে আর সব মহত্‍ সৃষ্টির মতো উঁচু দরের বনসাইয়েরও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে৷
বনসাই
ভালো বনসাইয়ের বৈশিষ্ট্য গাছ :
গাছের সামনের চেয়ে পেছনের দিকে প্রচুর পাতা থাকতে হবে৷ এতে করে গাছের গভীরতা বোঝা যাবে৷ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কাটা ডালপালা দেখা না যাওয়াই ভালো৷

শেকড় : প্রকৃতিতে যেমন গাছের শেকড় মাটির উপরে কিছুটা থাকে, বনসাইয়ের ক্ষেত্রেও তা থাকা দরকার৷ ধীরে ধীরে উপরের দিকে যত উঠবে তত চিকন হবে৷ মূল কান্ডটি সবচেয়ে মোটা হবে৷ দুই-তৃতীয়াংশ সামনে থেকে দেখা যাবে৷

শাখা-প্রশাখা : গাছের উচ্চতা থেকে অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে ডালপালা থাকবে৷ নিচ থেকে প্রথম ডালটি সবচেয়ে মোটা হবে৷ এভাবে উপরের দিকে ডাল ক্রমান্বয়ে চিকন হবে৷

গাছের বহিরাকৃতি : গাছের বহিরাকৃতি অনেকটা ত্রিভুজাকার হবে৷ ক্ষেত্রবিশেষে গোলাকারও হতে পারে৷

ফুল, ফল ও পাতা : মৃত ও অসুস্থ পাতা থাকবে না৷ সব পাতার একই আকার হবে৷ পোকামাকড় থাকবে না৷ ফুল-ফলে কোনো বিকৃতি থাকবে না৷

পাত্র : বনসাইয়ের টব বা পাত্র পরিষ্কার ও নিখুঁত হবে৷ টবের রঙ গাছের রঙ কিংবা ফুল, ফল ও পাতার রঙের সঙ্গে মানানসই হতে হবে৷ বনসাইয়ের পাত্র অপরিচ্ছন্ন থাকলে মশাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ হতে পারে৷

বনসাইয়ের স্টাইল নানা ধরনের হয়৷ তবে মূলত পাঁচটি স্টাইল৷
১. ফরমাল আপ রাইট : এই রীতির গাছগুলো চারদিকে সমানভাবে ডালপালা ছড়িয়ে উপরে ওঠে৷
২. ইনফরমাল আপ রাইট : এ রীতির গাছও উপরে ওঠে তবে ডালপালা সাধারণের মতো অত বিন্যস্ত নয়, একটু এলোমেলো৷
৩. কাসকেড : কাসকেড রীতির গাছগুলো টবের সীমানা ছাড়িয়ে ঝরনার মতো নিচের দিকে গড়িয়ে নামে৷ সেমিকাসডেক বা অর্ধকাসকেড রীতির গাছ টবের প্রান্তসীমায় এসে আটকে যায়৷ একমাত্র কাসকেড ও সেমিকাসকেড বনসাইতে উঁচু পট/টব ব্যবহার করা হয়৷
৪. স্পান্টিং : যে রীতির বনসাইয়ে গাছটি একদিকে হেলে থাকে তাকে স্পান্টিং বলে৷
৫. রুট ওভার রক : পাথরের ওপর যে বনসাই লাগানো হয় তাকে বলে রুট ওভার রক৷ এ ছাড়াও লিটার্চিক, টুইন ট্রাঙ্ক, মাল্টি ট্রাঙ্ক, রাফট ইত্যাদি নানা স্টাইলের বনসাই হয়ে থাকে৷ চিনে নিন খাঁটি বনসাই৷ কিছু দিন আগেও বাংলাদেশে বনসাই দুর্লভ ছিল৷ এখন অনেকেই বনসাই করছেন৷ ঢাকার বেশ কয়েকটি অভিজাত দোকান থেকে আপনি বনসাই কিনতে পারবেন৷ কিছু কিছু নার্সারিতেও বনসাই কিংবা বনসাই করার উপযুক্ত গাছ পাওয়া যায়৷ দুই-তিনশ টাকা থেকে কয়েক হাজার টাকা দামের বনসাই দোকানে বা নার্সারিতে কিনতে পাবেন৷ গত বৃক্ষমেলায় লাখ টাকার উপরে একাধিক বনসাই উঠেছিল৷ তবে বনসাই শুধু কিনলেই হবে না, তাকে চিনতে এবং রক্ষণাবেক্ষনও করতে হবে৷ মনে রাখতে হবে, গাছের বৃদ্ধি কখনো থেমে থাকে না, কাজেই যে অবস্থায় আপনি বনসাইটি কিনলেন তা কোনো স্থায়ী অবস্থা নয়৷ প্রতি বছরই গাছে নতুন ডালপালা আসবে, শেকড় বাড়বে এবং আপনার বনসাইয়ের চেহারা পাল্টাবে৷ কাজেই বনসাই কিনতে হলে এর সম্পর্কে একটু জেনেশুনে কেনা ভালো৷
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।