পাম চাষ
পাম চাষ : বহুমুখি লাভের কৃষি
পাম তেল:
পাম গাছের ফল প্রক্রিয়াজাত করে যে তেল পাওয়া যায় তাকে পাম তেল বলে। পাম ফলের মাংশল ও বীজ হতে তেল পাওয়া যায়। মাংশল অংশ হতে যে তেল পাওয়া যায় তার নাম পাম তেল, আর বীজ (কার্নেল) হতে যে তেল পাওয়া যায় তার নাম পাম কার্নেল তেল। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের শতকারা ৮০ ভাগ পাম তেল উৎপাদন করে।
ইতিহাস:
পাম তেলের আদি উৎস পশ্চিম আফ্রিকা। পাম তেলের মিশরে আবির্ভাব ঘটেছে সম্ভবত: পশ্চিম আফ্রিকা থেকে। মালয়েশিয়ায় ১৯১০ সালে Scotsman William Sime এবং Henry Darby নামের দুই ভদ্রলোক পাম চাষের প্রর্বতন করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম দফা পাম বীজ মালয়েশিয়া থেকে আনা হয় এবং পলিথিন ব্যাগে ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেনে চারা উৎপাদন করা হয়। ১৯৭৯ সালে মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়া থেকে আনা চারা দ্বারা প্রথম পাম চাষ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে কক্সবাজার এবং সিলেট বনবিভাগকে ছয় মাস বয়সের চারা রোপণের জন্য সরবরাহ করা হয় । ১৯৮১ সালে কক্সবাজারে ৩২৫ একর, চট্টগ্রামে ২৭৯ একর এবং সিলেটে ১৮০ একর মিলে মোট ৭৮৪ একর পাম চাষের আওতায় আনা হয়।
পামচাষের গুরুত্ব:
বাংলাদেশের বর্তমান ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ১২ লক্ষ মেট্রিক টন। দেশের চাহিদার মাত্র শতকরা ১০ ভাগ তেল দেশে উৎপাদিত হয় বাকি শতকরা ৯০ ভাগ তেলের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হয়। দেশে পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি করে প্রতি বছর যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হয় যদি পর্যাপ্ত পাম চাষ করা হয় তাহলে ১২,০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতি পাম চাষের উপযোগী। মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত পামের কাঁদি সাধারণত ৪০ কেজির বেশি হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে উৎপাদিত কাঁদির ওজন ৬০ কেজি থেকে ৬৫ কেজি পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে উৎপাদিত পামের ফল তুলনামূলক আকারে বড় এবং দানা তুলনামূলক ছোট। পাম থেকে তেল উৎপাদনের মাত্রার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার চেয়ে এগিয়ে।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমান:
সদ্য আহরিত পাম তেল বিটা ক্যারোটিনের সমৃদ্ধতম উৎস। পাম তেলে টোকোফেরল ও টোকোট্রায়েনল নামক দুই ধরনের ভিটামিন ‘ই’ অধিক পরিমাণে থাকে। অন্যান্য উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেলের মত পাম তেলও কোলেস্টেরলমুক্ত। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল খাদ্যে পাম তেল ব্যবহার করলে রক্তে মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে না। পাম তেল খাদ্যে ব্যবহার করলে দেহে উপকারী ‘এইচ.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে এবং ক্ষতিকর ‘এল.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। পাম তেল রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা হ্রাস করে ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়। লাল পাম তেলে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন ‘ই’ থাকে। যা গাজরের চেয়ে ১৫ গুন এবং টমেটোর চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। লাল পাম তেল ক্যারোটিনয়েডের উৎস হওয়ায় কয়েক ধরনের ক্যান্সারকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে পারে। পাম তেল এবং একই পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত অন্য ভোজ্য তেল সম্বলিত খাদ্যের সাথে তুলনা করে দেখা গেছে যে পরীক্ষামূলকভাবে ঘটানো স্তন্য ক্যান্সারের সংঘটন ও বিকাশ উভয় ক্ষেত্রেই পাম তেল প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র্য ও যুক্তরাজ্যের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ভোজ্য তেলের মধ্যে ৫০ পি.পি.এম. পর্যন্ত কোলেস্টেরল থাকলে তা ‘কোলেস্টেরল মুক্ত’ তেল হিসেবে বিবেচিত হয়। পাম তেলের কোলেস্টেরল ৫০ পি.পি.এম. এর নিচে যা (১৩-১৯) পি.পি.এম. এর মধ্যে। অপরপক্ষে সয়াবিন তেলে (২০-৩৫) পি.পি.এম. সূর্যমুখী তেলে (০৮-৪৪) পি.পি.এম.এবং সরিষার তেলে (২৫-৮০) পি.পি.এম. কোলেস্টেরল বিদ্যমান। চীনে পাম তেল, সয়াবিন তেল, পিনাট তেল এবং শুকরের চর্বি (সবগুলোই সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত) নিয়ে এক তুলনামূলক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে এদের মধ্যে পাম তেল দেহে উপকারী ‘এইচ.ডি.এল.’কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং ক্ষতিকর ‘এল.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
বিবিধ ব্যবহার:
পরিশোধিত পাম তেল গন্ধহীন হওয়ায় এর দ্বারা ভাজা খাদ্যেও স্বাভাবিক গন্ধ বজায় থাকে। পাম তেল অর্ধজমাট ঘনত্বে থাকার জন্যে এমন কিছু ভৌতগুণ ধারন করে যা অনেক খাদ্য প্রস্তুতিতে প্রয়োজন হয়। পাম তেল ভোজ্য তেল ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। সাবান, ডিটারজেন্ট, ফ্যাটি এসিড, ফ্যাটি এ্যলকোহল, গি্লসারল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। বিস্কুট, কেক, আইসক্রীমসহ বিভিন্ন প্রকার খাবার তৈরিতে পাম তেলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। চর্বি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে পাম তেল সকলের পছন্দনীয়। পাম তেল থেকে তৈরি হয় সলিড ফ্যাট যেমন বনস্পতি যা স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম কারণ পাম তেলকে হাইড্রোজিনেশন করার প্রয়োজন হয় না বলে এতে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি এসিড থাকে না। পাম গাছের কাণ্ড, পাতা, ফলশূন্য কাঁদি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা যায়।
পাম গাছের পাতা ও ফলশূন্য কাঁদির আঁশকে প্রক্রিয়াজাত করে মধ্য ঘনত্বের ফাইবার বোর্ড ও চিপবোর্ড তৈরি করা যায়। পাম গাছের গুঁড়ি থেকে চমৎকার আসবাবপত্র করা যায়। পাম গাছের পাতা মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে। এক টন পাম গাছের পাতা মাটিতে প্রায় ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ১.০৬ কেজি ফসফরাস, ৯.৮১ কেজি পটাশিয়াম ও ২.৭৯ কেজি ম্যাগনেশিয়াম যোগ করে ।
চাষাবাদ:
পাম গাছ চাষের জন্য মোটামুটি তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড হলে ভাল। বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ১৫০সেন্টিমিটারের বেশি তাই বাংলাদেশে পাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভবনা রয়েছে। প্রতিদিন ৫ ঘন্টা অথবা বার্ষিক মোট ২০০০ ঘন্টা সূর্যালোক দরকার। সমতল, ভারী, পানি ধারনক্ষম পলিমাটি পাম চাষের জন্য আদর্শ। বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা, অনাবাদি জমি, সড়ক-মহাসড়কের পাড়, পুকুর পাড়, অব্যবহৃত স্থানে পাম গাছ রোপণ করা যেতে পারে। প্রতি হেক্টর জমিতে ১২০টি থেকে ১৫০টি চারা অথবা ৯.৫ মিটার দূরে দূরে প্রতি হেক্টর জমিতে ১২৮টি চারা রোপণ করা যায়। বীজ হতে চারা তৈরি করতে এক বছর সময় লাগে। চারা রোপণের তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল ধরে। রোপিত চারা ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত ফল দিতে পারে। ৯.৫ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গর্ত করতে হবে। প্রতিটি গর্তের আকার ২×২×২ ঘন ফুট। প্রতিটি গর্ত জৈব সার দ্বারা ভরাট করতে হবে। জৈব সার শোধন করার জন্য একদিন (২৪ ঘন্টা) তামাক পাতা ভেজানো পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি গর্তে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০০ গ্রাম এমওপি সার প্রাথমিক মাত্রা হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে চারা রোপণের আগে অবশ্যই গতের্র জৈব সার বা কম্পোস্ট ভালভাবে ওলট-পালট করে গ্যাস বের করে দিতে হবে যাতে চারা গাছের কোন ক্ষতি না হয়। চারা রোপণের পর সবসময় মাটিতে যাতে পানি থাকে সেজন্য সেচ দিতে হবে।
ইঁদুরের আক্রমণ রোধ করার জন্য শতকরা ২ ভাগ জিংক ফসফাইট বিষটোপ ব্যবহার করে যেতে পারে। গন্ডার পোকার আক্রমণে গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গোঁড়া পচা রোগ যা Ganoderma boninense নামক জীবাণুর আক্রমণে ঘটে। এ রোগের কারণে শতকরা ৫০ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে। আইপিএম পদ্ধতিতে পোকাদমন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আক্রমণ রোধ করা যেতে পারে। ব্যাগওয়ার্ম ও ক্যাটারপিলারের আক্রমণ রোধ করার জন্য জৈব বালাইনাশক যেমন ব্যাকটেরিয়া Bacillus Thuringensis ব্যবহার করে যেতে পারে।
ফল সংগ্রহ:
সারা বছরই পাম গাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। ফিলিপাইনের আরবিএপি (জইঅচ) এর একটি প্রকাশনা অনুযায়ী চারা রোপণের ২৬ মাস থেকে ৩০ মাসের মধ্যেই ফসল সংগ্রহের পর্যায়ে পৌছায়। এক হেক্টর জমির পূর্ণবয়স্ক গাছে গড়ে বছরে কাঁদিসহ ফল ১৯.১ মে.টন পাওয়া যায়। মাসে তিন বার বা ১০ দিন পর পর ফল সংগ্রহ করা ভাল।
তেল প্রস্তুত:
পরিপক্ক ফলগাছ থেকে কাঁদিসহ কেটে নামিয়ে পরিস্কার করতে হবে। তারপর ফলগুলোকে পাত্রের মধ্যে পানিসহ ফুটাতে হবে এতে ফলগুলো নরম হয়। এবার নরম ফলগুলোকে হাতে চেপে রস বের করতে হবে। তারপর পানি মিশ্রিত এ রসকে একটি পাত্রে রেখে চুলায় কিছুক্ষণ তাপ দিলে রসে বিদ্যমান পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে যাবে এবং পাত্রের মধ্যে পাম তেল জমা থাকবে। এ ভাবে প্রাপ্ত তেল ছেঁকে বোতলে সংগ্রহ করে রাখলে ছয় মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোটা, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজ নিজ আঙ্গিনা ও অব্যবহৃত স্থানে পাম গাছের রোপণের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে পাম তেল একদিন হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি।
সংকলনে: মুহম্মদ আরশেদ আলী চৌধুরী, মেহেরপুর
পাম বা অয়েল পাম চাষ
নানা সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। বিশেষত কৃষিতে এ সম্ভাবনা আরও বেশি। এমনি একটি নতুন সম্ভাবনার নাম অয়েল পাম চাষ। খাদ্য শস্যের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি বর্তমানে ভোজ্যতেলের নিরাপত্তাহীনতা দেশের অন্যতম সমস্যা। প্রতি বছর ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ আমাদের বর্তমান প্রায় ১৩০ কোটি ইউএস ডলার ব্যয় হয়। অয়েল পাম চাষ করে আমরা সহজেই ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ টাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংক সাশ্রয় করতে পারি।
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু অয়েল পাম চাষের জন্য অত্যন- উপযোগী। এ দেশের রাঙ্গামাটি, দুদুকছড়ি (খাগড়াছড়ি), কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গার দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলায় অয়েল পাম সন্দেহাতীতভাবে চাষ করা সম্ভব।
দিনাজপুরের হাজী দানেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টি, ঘাটাইলের রামজীবনপুরে ২টি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৩টি গাছের সবকটিতে ফল আছে।
সুনিষ্কাশিত প্রায় সবধরনের মাটিতে অয়েল পাম চাষ সম্ভব। বাংলাদেশের কঙ্বাজার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, পার্বত্য এলাকাসহ ৩০টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে ২৭টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলেই অয়েল পাম চাষ সম্ভব। উঁচু ও মধ্যম এবং বন্যার পানি আসে কিন্তু বেশিদিন থাকে না এমন জমিতেও অয়েল পাম চাষ করতে হয়।
পৃথিবীতে জমি ব্যবহারের দক্ষতা এবং উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে সব ধরনের তৈল জাতীয় শস্যের (সয়াবিন, সরিষা, তিল, তিষি, সূর্যমুখী ইত্যাদির) মধ্যে অয়েল পামে চারগুণ বেশি তেল বিদ্যমান। বাংলাদেশের অয়েল পামে শতকরা ৬০ ভাগ পাম অয়েল আছে। অয়েল পাম একটি এনার্জি এফিসিয়েন্ট ফসল। চাষ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে সার, বালাইনাশক, ফসল জ্বালানির ব্যবহার তুলনামূলক কম হয়। প্রতিহেক্টর জমিতে ৪ টন পাম অয়েল বছরে উৎপাদিত হয় কিন্তু বর্তমানে মালেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে হেক্টরপ্রতি ৭ টন পাম অয়েল উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্নজাত উদ্ভাবিত হয়েছে।
একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, অন্যান্য কৃষি ফসল চাষ করে যেখানে হেক্টরপ্রতি ১২১০ ইউরো আয় হয়, সেখানে অয়েল পাম চাষ করে ১৬১৭ ইউরো আয় করা সম্ভব অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতিহেক্টরে অয়েল পাম চাষ করে বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব।
অয়েল পাম যেহেতু একটি পাম জাতীয় গাছ তাই অন্য ফসলের সঙ্গে জায়গা, বাতাস, খাদ্য উপাদান সূর্যালোক ইত্যাদির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। উঁচু জমির আইল, শিক্ষাদানের পতিত জমি, ক্যান্টনমেন্ট, রাস্তার দুপাশ, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পতিত জমি, পাহাড়ি অঞ্চলের পাদভূমির বিশাল এলাকা এ চাষের আওতায় আনা সম্ভব।
উপকূলীয় বিশাল এলাকা অয়েল পাম চাষের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা যায়।
মালেশিয়া ১৯৬০ সালের পর Land Setlement Scheme এর আওতায় অয়েল পাম চাষ ব্যাপকভাবে শুরু করে। দারিদ্র বিমোচন সফল হয়েছে এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাম অয়েল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সবার ভোজ্যতেলের বিকল্প হিসেবে অয়েল পাম বাণিজ্যিকভিত্তিতে এবং প্রতি বাড়িতে ২/১টি করে চাষ করা উচিত। অয়েল পাম সারাবছরই ফল দেয় বিধায় এর উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িত শ্রমিকদের সারা বছরই কর্মে জড়িত থাকার সুযোগ থাকে।
অয়েল পাম গাছ রোপণের তৃতীয় বছর থেকে ২৫ বছর পর্যন- লাভজনক ফলন দেয়। যেকোন দেশের দারিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য একটি আয়বর্ধক ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের অয়েল পাম চাষকে দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম একটি উৎস হিসেবে বিবেচনা করে কাজে লাগানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সরকারি খাস জমিতে অয়েল পাম চারা রোপণের মাধ্যমে বিডিআর এর সহায়তায় বিশেষ আয়বর্ধক সামাজিক কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
একটি পরিবারের জন্য দুটি পামঅয়েল গাছই যথেষ্ট
বিশ্বে তেল উৎপাদনে পামঅয়েল গাছ অনেক এগিয়ে রয়েছে। এই গাছ যদি আমাদের দেশে পাহাড়ি পতিত ভূমিতে এবং সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে সারাদেশে লাগানো যায় তবে ৫-৭ বছরের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠিতে পরিণত করা সম্ভব।
পামঅয়েল গাছ একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। রোপণের ৩-৪ বছরের মধ্যেই ফলন দিতে শুরু করে। ফলন শুরুর পর থেকে প্রতিমাসে একটি করে কাঁদি দেয় এবং সেই কাঁদি থেকে তেল সংগ্রহ করা যায়। এই গাছ একটানা ২৫-৩০ বছর পর্যন- ফলন দেয়। অন্য যেকোন ভোজ্য তেলের ফসল থেকে পাওয়া তেল অপেক্ষা এই তেল ১৫ গুণ বেশি হয়ে থাকে। ফুলটির মাংসল অংশকে বলা হয় মেসোকার্প যা থেকে পাম তেল আহরণ করা হয় আর বীজ বা শাঁশ থেকে পাওয়া যায় পাম কর্ণেল তেল। প্রতিটি পাম ফল থেকে ৯ ভাগ পাম তেল ও ১ভাগ পাম কর্নেল তেল পাওয়া যায়।
আমাদের দেশিয় পদ্ধতিতে সহজেই পাম তেল সংগ্রহ করা যায়। যেমন_ একটু পানিতে পাকা পাম ফল সিদ্ধ করে হাত দিয়ে চিপা দিলে তেল বের হয়ে আসবে। যদিও এই তেলে থাকবে পানির মিশ্রণ। মিশ্রণটি চুলায় জ্বাল দিলে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে এবং তেলটুকু থেকে যাবে।
বাংলাদেশের মাটি উর্বর। হেলায় ফেলায় চাষ করলেই অনেক ফসল জন্মে। তাইতো দেশে মাটিকে সোনার সাথে তুলনা করেছেন কবি। আমাদের দেশের এই মাটিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়- বেলে মাটি, এঁটেল মাটি ও পলি মাটি। বেলে মাটি আবার দুই প্রকার- বেলে চর ও বেলে দো-আঁশ। পাম গাছ চাষ করার জন্য তিন প্রকার মাটি-ই উপযোগী। পাম গাছ চাষের জন্য মাটিতে পিএইচ -এর ৪-৭ প্রয়োজন (পিএইচ বলতে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্বর পরিমাণকে বুঝায়)। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকার পিএইচ-এর মাত্রা ঠিক থাকায় পামঅয়েল গাছ চাষ সম্ভব।
পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পামঅয়েল গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পামঅয়েল গাছ চাষে সামান্য পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। পাম ফল থেকে পাম তেল সংগ্রহের সময় যে পুষ্টিসমৃদ্ধ বর্জ্য পাওয়া যায় সেটাই সার হিসেবে পাম গাছে ও গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করার জন্য পামঅয়েল উদ্ভিদের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের করার জন্য জৈব পদ্ধতিই ব্যবহার করাই ভাল।
বিশ্বে এখন পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য “শূন্য বর্জ্য ও শূন্য দহন” পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এই গাছের পাতা, গুঁড়ির শূন্য কাঁদি ব্যবহার করে নতুন নতুন দ্রব্য উৎপাদন করা হচ্ছে। পাতা ও ডাল না পুড়িয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাম গাছের এক টন পাতা মাটিতে ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ১.০৬ কেজি ফসফরাস, ৯.৮১ কোটি পটাসিয়াম ও ২.৭৯ কেজি ম্যাগনেসিয়াম ফিরিয়ে দেয় এবং এই গাছ বাতাস থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে।
সারা বাংলাদেশে পামঅয়েল চাষ ছড়িয়ে দিতে সরকারকে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চাষাবাদ বাস-বায়িত করতে হবে। গণমাধ্যমকে প্রচারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে পামওয়েল গাছ চাষ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে পাম চাষের প্রসার ঘটাতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এবং পাবর্ত্য এলাকার উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন যে সব রস্তা আছে সে রাস্তার দুপাশে পামঅয়েল গাছ লাগানো যেতে পারে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির ও হাসপাতালের অব্যবহৃত জায়গায়ও পাম চাষ করা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাবাদি পতিত জমি, পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল ও উপকূল অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ অভিযানের মাধ্যমেও পামঅয়েল চাষ করা যায়।
একটি পরিবারে দুইটি পামঅয়েল গাছ চাষ করলে ওই পরিবারের সারা বছরের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ হবে। প্রতিটি পরিবার যদি অয়েলপাম চাষে এগিয়ে আসে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের তেল আমদানি করতে হবে না।
বাংলাদেশ বছরে সাত লক্ষ টন পাম তেল আমদানি করে থাকে। যার মূল্য ১২ হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি পামঅয়েল গাছ চাষের মাধ্যমে দেশে পাম তেলের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি, তাহলে দেশের ১২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব। এছাড়া অধিক উৎপাদনে আমরা বিদেশে রফতানি করে আয়ও করতে পারি বৈদেশিক মুদ্রা।
লেখক: মনজুর হোসেন,এগ্রিকালচার ফার্ম, কুমিল্লা
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।