আলুর সাথী ফসল চাষ
আলু বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত সবজি ফসল। এতে মানুষের শরীরে সস্তায় শক্তি সরবরাহকারী প্রচুর পরিমাণে শর্করা, উন্নত মানের প্রোটিন, ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশে আলু প্রধানত সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পৃথিবীর অনেক দেশে আমাদের ভাত বা রুটির মতো আলু প্রধান খাদ্য রূপে ব্যবহৃত হয়। এর হেক্টরপ্রতি ফলন ধান বা গম থেকে কয়েক গুণ বেশি এবং অল্প সময়ে এ ফসল থেকে প্রচুর পরিমাণে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপন্ন করা যায়। তাই আলুর চাষ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
আলু প্রধানত একক ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। একক ফসল ছাড়াও আলু ফসলের দুই সারির মাঝের ফাঁকা জায়গায় সাথী ফসল (Inter crop) হিসেবে লাল শাক, পালং শাক, ধনে ও মুলা শাকের চাষ করা যায়। এতে প্রধান ফসল আলুর কোনো ক্ষতি হয় না। বরং একই জমি থেকে একই চাষ খরচে স্বল্প সময়ে একটা বাড়তি ফসল উৎপাদন করে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়া যায়।
চাষাবাদ প্রণালী:
মাটি নির্বাচন : পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত আলো-বাতাসময় উর্বর দোআঁশ ও বেলে দোআশঁ মাটিতে আলু ও সাথী ফসলের চাষ করা যায়।
জাত নির্বাচন : আলুর জন্য কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, আইলসা, মুল্টা, পেট্রোনিজ, হিরা, কুফরী সুন্দরী, মোরিনী, ওরিগো, চমক, ধীরা, গ্রানোলা, কিওপেট্রা এসব উন্নত জাত নির্বাচন করা যায়। আর সাথী ফসল হিসেবে লাল শাকের জন্য আলতাপাতি, পালং শাকের নবেল জায়েন্ট, বানার্জি জায়েন্ট, অলগ্রিন ও পুষ্পজ্যোতি, মুলার জন্য তাসাকিসান, পিংকি, লাল বোম্বাই, মিনোআর্লি, মিয়াশিকো, স্নো হোয়াইট, দ্রুতি ও ধানের জন্য স্থানীয় জন্নত জাত নির্বাচন করতে হবে।
সময় : মধ্য কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ পর্যন্ত আলুর বীজ বপন করা যায়। এ একই সময়ে সাথী ফসলও আলুর সাথে চাষ করতে হবে।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ : আলুর জন্য মাটি ১৫-২০ সেন্টিমিটার গভীর করে চাষ দেয়া প্রয়োজন, যাতে মাটিতে আলুর শিকড় ও কন্দ আনায়াসে বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই পাঁচ-ছয়টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি আলগা ও ঝুরঝুরে করে নিয়ে জমি যথাসম্ভব সমতল করে নিতে হয়। আলুর জন্য যে চাষ দেয়া হয় ওই একই চাষে সাথী ফসলেরও চাষ হয়।
আলুর জন্য প্রতি হেক্টরে ১০ টন পচা গোবর, ২০০ কেজি ইউরিয়া, ১৫০ কেজি টিএসপি ও ২০০ কেজি এমওপি সার প্রয়োজন। শেষ চাষের সময় সমুদয় গোবর মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। আর সম্পূর্ণ টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার আলু বীজ বপনের জন্য তৈরী নালায় প্রয়োগ করে পাঁচ সেন্টিমিটার মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। একই সাথে সাথী ফসলেরও চাষ করা যায়।
বীজ বপন : আলুবীজ সারিতে বপন করতে হবে। ৬০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে প্রতি সারিতে ২৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে চার-পাঁচ সেন্টিমিটার গভীর ও সরু নালায় বীজআলু বসিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। ছোট আকারের বীজ আলু (২৮-৩৫ মি. মি.) আস্ত ও বড় আকারের বীজ আলু (৩৫-৫৫ মি. মি.) লম্বালম্বিভাবে দুই বা তিন টুকরো করে কেটে লাগানো যায়। তবে ল্য রাখতে হবে যেন প্রতি টুকরোর ওজন ১৫-২৮ গ্রাম হয় এবং প্রতি টুকরোতেই অন্ততপে দুটো চোখ থাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৫-২.০ টন বীজআলু প্রয়োজন হয়।
আলুবীজ বসানোর পর দুই সারির মাঝের ফাঁকা জায়গায় লাল শাক, পালং শাক, মুলা ও ধনে শাকের বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বুনে তার ওপর এক সেন্টিমিটার পুরু করে শুকনো ঝুরঝুরা মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। তারপর ঝাঁঝরি দিয়ে একটা হালকা সেচ দিতে হবে। পালং শাক ও ধনে শাকের বীজ বোনার আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে পানি থেকে ছেঁকে নিয়ে বীজ ছিটিয়ে বুনতে হয়। হেক্টরপ্রতি ২৫ কেজি পালং শাক, ২.০ কেজি লাল শাক, পাঁচ কেজি মুলা ও ১৫ কেজি ধনের বীজ প্রয়োজন।
শাক সংগ্রহ : বীজ বপনের এক মাস পর লাল শাক, পালং শাক, মুলা ও ধনে শাক তুলতে হবে। হেক্টরপ্রতি ৮-১০ টন পালং শাক, পাঁচ-ছয় টন লাল শাক, সাত-আট টন মুলা শাক এবং দুই-তিন টন ধনেপাতা উৎপন্ন হতে পারে। শাক তোলার পর (অর্থাৎ সাথী ফসল) আলুর জন্য অনুমোদিত অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সারের অর্ধেক আলুর দুই সারির মাঝে প্রথমবার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার প্রথম কিস্তির এক মাস পর দ্বিতীয় কিস্তিতে সারির দুই পাশে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের পর দুই সারির মাঝখানের মাটি কোদাল দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। এ সময় জমির আগাছা দমনের কাজও হয়ে যায়। তারপর নরম ঝুরঝুরা মাটি কোদাল দিয়ে টেনে সারিতে গাছের দুই দিকে দিয়ে ভেলি বেঁধে দিতে হবে। আর এর পরই জমিতে পানি সেচ দিতে হবে। সারির মাঝখানের নালা দিয়ে ভেলির দু-তৃতীয়াংশ ভরে পানি সেচ দিতে হয়। এতেই ভেলির উপরি ভাগ শোষিত পানি দিয়ে ভিজে যাবে। এ ছাড়া সেচের অতিরিক্ত পানি যাতে কোথাও আটকে না থাকে সেদিকে ল রাখতে হবে।
লেখক : মো: আবদুর রহমান
Trackbacks & Pingbacks
[…] ভূমিতে শীতকালে এবং পার্বত্য অঞ্চলে গ্ৰীষ্মকালে ও শরৎকালে আলুর চাষ হয় । আলুই একমাত্র ফসল যে কিনা খুব […]
Comments are closed.