দেশি পারিজা জাতের ধান

দেশি পারিজা জাতের ধান চাষ

দেশি পারিজা জাতের ধান চাষ (বোরো ও আমন মৌসুমের মাঝে)

১৬ কোটি মানুষের এই দেশে খাদ্য চাহিদা মেটাতে উত্পাদন বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছর ৬৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। বর্ধিত জনগোষ্ঠির বাসস্থান, শিল্প কারখানা, অফিস আদালত ইত্যাদি স্থাপনই এর মূল কারণ। ফলে বিশাল এই জনগোষ্ঠির খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এর সাথে যোগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খাদ্যশস্যের উত্পাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশংকা। যেহেতু চাষযোগ্য জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই একই জমি থেকে এক বছরে বর্তমানে যে পরিমাণ ফসল পাওয়া যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ফসল উত্পাদনের মাধ্যমে এই বর্ধিত জনগোষ্ঠির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজন হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

এপ্রিল মাসের শেষদিকে বোরো ধান কাটা শুরু হয়। একই জমিতে কৃষক জুলাই-আগস্ট মাসের প্রথমদিকে আমন ধানের চারা লাগায়। মাঝখানের ৭০ থেকে ৭৫ দিন এই জমিগুলো ফাঁকা থাকে। ফাঁকা থাকা সময়টুকুকে কাজে লাগিয়ে কৃষক একটি অতিরিক্ত ধান ফলাতে পারে। আরডিআরএস এর গবেষণায় দেখা গেছে, যদি এপ্রিলের শেষে বোরো ধান কাটার পর জমি চাষ করে ১৫ থেকে ২০ দিন বয়সের পরিজা জাতের ধানের চারা রোপণ করা যায়, তাহলে জুলাই-আগস্ট মাসের মধ্যেই এই ফসল ঘরে তোলা যায়। অর্থাত্ চারা রোপণের মাত্র ৭০ থেকে ৭২ দিনের মধ্যেই এই ধান কাটা যায়। এরপর জুলাই-আগস্টে জমি চাষ করে আমন ধানের চারা রোপণ করলে নভেম্বর মাসে আমন ধান ঘরে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে বছরে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টন চালের ঘাটতি হয়। এই বিভাগে একই জমিতে বোরো এবং আমন হয় এ ধরনের ৬ লক্ষ হেক্টর জমি আছে, যেখানে পারিজা ধানের চাষ করা যায়। সারা দেশে ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে তিন ফসলের এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করে খাদ্য নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা যায়। এই বিভাগে ৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করলে ১৮ লক্ষ টন অতিরিক্ত ধান ঘরে আসবে। সারা দেশে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারলে ৯০ লক্ষ টন ধান উত্পাদন সম্ভব। এই প্রযুক্তির বদৌলতে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে অতিরিক্ত চাল বিদেশে রফতানি করা যেতে পারে।

ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য প্রতি হেক্টরে ৫০ থেকে ৬০ জন কৃষি শ্রমিকের প্রয়োজন। এই বিভাগে ৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করলে প্রায় ৪ কোটি কর্ম দিবসের সৃষ্টি হবে। এতে ২৫ লক্ষ কৃষি শ্রমিক ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ পাবে।

বাংলাদেশে মে, জুন ও জুলাই মাস বৃষ্টিপাতের মাস। সাধারণত মে মাসে গড়ে ৩৫০ এমএল, জুন মাসে গড়ে ৫৫০ এমএল এবং জুলাই মাসে ৫০০ এমএল বৃষ্টি হয়। যেহেতু মে, জুন এবং জুলাই মাসের প্রথমার্ধে জমিতে কোনো ফসল থাকে না, তাই এই বৃষ্টিপাত বর্তমান চাষাবাদে কোনো কাজে আসে না। তিন ফসলের এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন হলে মে, জুন এবং জুলাই মাসের বৃষ্টিপাতকে কাজে লাগানো যাবে। সেচ কাজে মাটিস্থ পানি ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর ৪ সে.মি. করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের উপর হুমকি স্বরূপ এবং আগামী প্রজন্মের কাছে খাওয়ার পানি (টিউবওয়েলের পানি) দুষপ্রাপ্য হয়ে উঠবে। সুতরাং ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে বৃষ্টির পানিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যথার্থ ভূমিকা রাখবে।

সাধারণভাবে ধান চাষে দেখা যাচ্ছে, বোরো ধানে একর প্রতি ২৫ হাজার এবং আমন ধানে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে পারিজা ধান চাষে মাত্র ১৪ হাজার টাকা খরচ হবে। ধানের মূল্য অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের তুলনায় কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেহেতু পারিজা ধান চাষ করতে উত্পাদন খরচ বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক, সেহেতু এই ধান চাষ প্রযুক্তি সমপ্রসারণ করতে পারলে কৃষকের লাভ হবে এবং কৃষির উন্নতি ঘটবে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন প্রায় প্রতি বছর নাবী বন্যা হচ্ছে। গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবগুলো বন্যাই হয়েছে ২৬ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এই ধান যেহেতু জুলাই মাসের শেষে কাটা হচ্ছে, তাই বন্যা থেকে এই ধান রক্ষা পাচ্ছে। অর্থাত্ ঝুঁকিবিহীনভাবে কৃষক এই ধান চাষ করতে পারবে। আমাদের দেশ থেকে দেশি ধান হারিয়ে যাচ্ছে, যে ধানের ভাত খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এই সমস্ত দেশি ধানের বেশকিছু গুণ বা বিশেষত্ব আছে; যেমন- বেশ কিছু দেশি ধানের জাত খুব অল্প সময়ে পাকে। অনেক ধানের জাত খরাসহিষ্ণু এবং পোকামাকড় প্রতিরোধ করতে পারে। আউশ মৌসুমে পারিজা জাতের দেশি ধান চাষ প্রযুক্তি হারিয়ে যাওয়ায় এই সমস্ত দেশি ধানের জাতকে পুনরুদ্ধার করতে পারে, যা পরিবেশবান্ধব বলে প্রমাণিত।

মে, জুন ও জুলাই মাস বৃষ্টিপাতের সময় বিধায় এ সময় ধান ছাড়া অন্য ফসল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই এই আউশ মৌসুমে বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগিয়ে কম খরচে আউশ ধান চাষ করা যায়। আউশ ধান কেটে কৃষক আমন ধান করতে পারবে। অন্যদিকে উঁচু জমিতে যেখানে প্রচুর সেচ দিতে হয়, সেখানে কৃষককে অধিক উত্পাদন খরচে বোরো ধান উত্পাদন না করে অল্প পানি খরচ করে অন্যান্য রবি ফসল যেমন- ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি, আলু ইত্যাদি চাষ করতে উত্সাহিত করা যায়। যেহেতু কৃষক একই বছরে পারিজা ও আমন ধান পাচ্ছে, তাই উঁচু জমিতে বেশি উত্পাদন খরচে বোরো ধান করতে কৃষক বেশি আগ্রহী হবে না। বোরো ধান শুধুমাত্র নিচু ও মাঝারী নিচু জমিতে যেখানে পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, শুধুমাত্র সেখানেই কৃষককে উত্সাহিত করতে হবে। এতে দেশের ভূগর্ভস্ত পানি উত্তোলনের চাপ কমবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিদ্যুত্ ও ডিজেল সাশ্রয় হবে। সরকার বোরো মৌসুমে বিদ্যুত্ ও ডিজেল সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও অব্যাহতি পাবে।

আরডিআরএস ২০০৮ সাল থেকে বোরো এবং আমনের মাঝে আউশ মৌসুমে একটি অতিরিক্ত ফসল হিসেবে স্বল্পমেয়াদি পারিজা ধানের প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে সমপ্রসারণ করে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর এই প্রযুক্তি সমপ্রসারণে আরডিআরএসকে সক্রিয় সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ এই প্রযুক্তি কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা এই প্রযুক্তি গ্রহণে করায় সারা বছরই তাদের খাদ্যের সংস্থান হচ্ছে।
লেখক: ড.এম.জি.নিয়োগী,
হেড অব এগ্রিকালচার এন্ড এন্ভায়রনমেন্ট, আরডিআরএস বাংলাদেশ

এগ্রোবাংলা
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।