কুলের রোগ ও প্রতিকার
শীতকালের সবেধন নীলমণি দেশীয় ফল হলো কুল। সম্প্রতি দেশে প্রচুর কুল গাছ লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে আপেল কুল ও বাউকুলের ছোট বড় অনেক বাগান গড়ে উঠেছে। সেসব বাগানের গাছে গাছে এখন ফল ধরেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, বেশির ভাগ বাগানেই কচি কুলে এখন বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতে কচি ফল নষ্ট হচ্ছে, এমনকি শেষে সেসব ফল ঝরে গাছ খালি হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন জাতের কুল আবাদের ফলে এখন কুলেও বেশ কিছু নতুন নতুন সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যা আগে কখনো এ দেশে দেখা যায়নি। ফলে সেসব সমস্যাকে বুঝতে যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি তার সঠিক প্রতিকারও মিলছে না। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোজই কুলচাষিদের কাছ থেকে দু-চারটা ফোন পাচ্ছি। এসব সমস্যার কিছু হয়েছে কিছু নতুন পোকার কারণে, কিছু আছে নতুন রোগ এবং কিছু ঘটছে বোরন ও ম্যাগনেসিয়াম সারের ঘাটতির কারণে। এ জন্য নতুন জাতের কুল বিশেষ করে আপেল কুল ও বাউকুল চাষ সম্প্রসারণের পাশাপাশি সেসব জাতের কুল রার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার ওপরও জোর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
এবার কচি কুলে যেসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে তা অঞ্চলভেদে ভিন্ন। যেমন রংপুরের গঙ্গাচড়ায় কচি কুলের ওপর সাদা গুঁড়ো পড়ে ফল শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে, সাতীরার কালিগঞ্জে কচি ফলের ওপর সাদা নরম গাদা ধরে পোকা বসে রস চুষে খেয়ে ফল শুকিয়ে ফেলছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কচি কুলের গায়ে কালো কালো দাগ পড়ছে ও নলের মতো খোলের ভেতর এক ধরনের পোকা লুকিয়ে থেকে ফুল-ফল খেয়ে নষ্ট করছে এবং গাছকে কুলশূন্য করে ছাড়ছে, নাটোরে কচি ফল ছিদ্র করে খেয়ে যাচ্ছে এক ধরনের পোকা। এসব রোগ ও পোকা সঠিকভাবে শনাক্ত করে সময়মতো প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিতে পারলে আক্রান্ত গাছে কুলের উৎপাদন এবার অনেক কমে যেতে পারে। তাই যেসব কুলচাষি কুল নিয়ে এরূপ সমস্যায় পড়েছেন তাদের জন্য সমস্যার প্রকৃতি ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
কচি কুলের ওপর সাদা গুঁড়োর মতো আবরণ পড়ে একটি রোগের কারণে। কুলের এটি একটি সাধারণ রোগ। সাদা গুঁড়োর মতো আবরণ পড়ে বলে এ রোগকে সাদা গুঁড়া রোগ বা পাউডারি মিলডিউ রোগ বলে। কুল গাছের পাতা, ফুল ও ফলে এ রোগ আক্রমণ করে। সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এ রোগ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত অংশের ওপর সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে সমগ্র পাতা, ফুল ও ফলকে আবৃত করে এবং শেষে বাদামি বর্ণ ধারণ করে। এতে ফুল ও ফল ঝরে পড়ে। শুধু কচি ফলেই নয়, অনেক সময় ফল পাকার সময়ও এ রোগ আক্রমণ করে। তখন আক্রান্ত ফল ফেটে যায়। এতে ফল বাজারজাত করার অযোগ্য হয়ে যায়। এ রোগ যাতে বাগানে না হতে পারে সে জন্য গাছ ও বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, কুলগাছের মরা, শুকনো ও রোগাক্রান্ত ডালপালা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আর রোগ দেখা দিলে থিওভিট প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম অথবা ডাইথেন এম৪৫ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে পাঁচ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দুই-তিন বার গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কুলের ওপর কালো কালো দাগ পড়ছে অন্য একটি রোগের কারণে। তবে কুলের জন্য এ রোগটি এ দেশে নতুন। প্রাথমিকভাবে এ রোগকে অ্যানথ্রাকনোজ বা শুকনো ত রোগ বলে ধারণা করা হচ্ছে। কচি ফলেই এ রোগ আক্রমণ করছে। খুব ছোট ফলও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগের আক্রমণে ফলের ওপর প্রথমে বিন্দু বিন্দু কালো কালো দাগ পড়ে। দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। দাগগুলো প্রায় গোলাকার। প্রথমে বিপ্তিভাবে দাগ পড়ে, পরে অনেক দাগ আবার একত্রে মিলে বড় দাগ তৈরি করে। আক্রান্ত ফল আশানুরূপ বড় হতে পারে না, সবুজ রঙ ফিকে হয়ে আসে এবং অনেক ফল ঝরে পড়ে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ও বাতাসের আর্দ্রতা বেশি হলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ রোগ দেখা দিলে গাছের নিচে ঝরে পড়া রোগাক্রান্ত ফল একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। এমনকি সম্ভব হলে আক্রান্ত ফল হাত দিয়ে গাছ থেকে তুলে একইভাবে ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ কম থাকলে এরূপ কাজ করে সহজে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কচি ফল ও গাছে টিল্ট২৫০ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে পাঁচ মিলিলিটার অথবা ডায়থেন এম৪৫ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে আর এ রোগ কুল গাছে আক্রমণ করতে না পারে সে জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাছ ও বাগান পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এমনকি গাছের নিচে ঝরে পড়া মরা পাতা কিছু দিন পরপর পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
কচি ফলের ওপর সাদা সাদা নরম নরম ছাতার মতো এক ধরনের পোকা দেখা যাচ্ছে। এগুলোকে বলে ছাতরা পোকা বা মিলিবাগ। আধুনিক জাতের কুল চাষে এটি একটি অতি তিকর পোকা। নারিকেলি কুল ও বাউকুলে এ পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়। এ পোকা দেখতে অনেকটা সাদা, মোমের প্রলেপ দিয়ে ঢাকা। ক্ষুদ্র পোকারা গুচ্ছাকারে অনেকটা ক্ষুদ্র তুলার দলার মতো দেখায়। পাতার গোড়ায়, কচি ডালের ভাঁজে ও ফলের বোটায় বসে রস চুষে খায়। হাতে সামান্য চাপ দিলেই গলে যায়। এ পোকার আক্রমণে কচি ফলের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। আক্রান্ত পাতাসহ ডগা কুঁচকে যায় বা মুড়িয়ে যায় এবং অধিক আক্রমণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ গাছটাই পোড়ার মতো বা ভাইরাস আক্রমণের মতো দেখায়। এদের শরীর থেকে বের হওয়া মধুর মতো চটচটে আঠালো পদার্থ গাছের পাতায় পড়ে এবং পাতায় ধূসর রঙের মতো একটা আবরণের সৃষ্টি করে। এসব রস মিষ্টি। তাই সে রস খেতে পিঁপড়া ভিড় জমায়। আক্রান্ত গাছে পিঁপড়ার আনাগোনা দেখলেই বুঝতে হবে গাছে ছাতরা পোকা লেগেছে। এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে অল্প আক্রমণ হলে নরম কাপড়ে কেরোসিন বা পেট্রল মাখিয়ে তা দিয়ে আক্রান্ত অংশ মুছে দিতে হবে। এতে পোকা মরে যাবে। বাগানে নিয়মিত পর্যবেণ করা এবং আক্রান্ত ফল, ডাল ও পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলে এ পোকার আক্রমণ অনেক কমানো যায়। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪০ গ্রাম গুঁড়া সাবান পানিতে গুলে স্প্রে করেও পোকা দমন করা যেতে পারে। আক্রমণ বেশি ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত গাছ ও তার পাশের গাছে এডমায়ার বা রিজেন্ট কীটনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলিলিটার গুলে ডাল ও পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ১০-১৫ দিন পর পর দুই তিন বার একইভাবে স্প্রে করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে একই বাগানে আর এ পোকার আক্রমণ না হয় সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পোকা মাটি দিয়ে হেঁটে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যায়। সেহেতু গাছের গোড়ায় ১-৩ ইঞ্চি আলকাতরা, পিচ, টিনের পাত, আঠালো মাটি বা অন্য কোন অপোকৃত দীর্ঘস্থায়ী আঠালো দ্রব্য গোল করে দিলে পোকা বিস্তার ঘটাতে পারে না।
কচি ফলে আর এক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো পোকায় ফল ছিদ্র করা। কুলের কেড়ি পোকা বা উইভিল নামে এক পোকা এ তি করে চলেছে। নভেম্বরে অর্থাৎ মওসুমের শুরুতে এ পোকা কুলের মারাত্মক তি করে থাকে। ফুল থেকে কুলের গুটি বাঁধা শুরু হলে এ পোকার আক্রমণ ল করা যায়। সাধারণত আপেল কুলে এদের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত গাছে ঝোপা ঝোপা গোল কুলের আকৃতির ফল হয় এবং বৃদ্ধি কমে যায়। এরূপ ফল দুই ভাগ করলেই ভেতরে পোকা দেখা যায়। পোকার বাচ্চা হলুদ রঙের বা আর পূর্ণাঙ্গ পোকা বাদামি রঙের। ভেতরে দুই ধরনের পোকাই দেখা যায়। গুটির মধ্যেই এ পোকার ডিম থেকে বাচ্চা হয় এবং পরে পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়। পূর্ণাঙ্গ পোকা পরে গুটির গা ছিদ্র করে বেরিয়ে আসে। এ পোকায় আক্রান্ত কুলে বীজ হয় না এবং বড় হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে, ফলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ পোকা আক্রমণ ঠেকাতে হলে গাছ ও বাগানের মরা পাতা, আবর্জনা ও জঙ্গল সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। কুলগাছের কোথাও ফাটল বা কোটর থাকলে তা গোবর ও মাটির মিশ্রণ দিয়ে বন্ধ করতে হবে। আক্রান্ত ফল পেলে তা ধ্বংস করতে হবে। ফুল আসার শুরুতেই কীটনাশক ১৫ দিন পর পর এক দুই বার কীটনাশক (রিজেন্ট) স্প্রে করতে হবে। কুলে এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে প্রথমেই আক্রমণের পরিমাণ কম থাকতেই আক্রান্ত ফলগুলো তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। তবে একবার আক্রমণ হয়ে গেলে এদের দমন করা খুবই কষ্টকর। আক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত গাছগুলো এবং পাশের গাছে রিজেন্ট বা এ জাতীয় কোনো কীটনাশক দ্বারা বিকেলে স্প্রে করা যেতে পারে। এতে কাজ না হলে কীটনাশকের মাত্রা দ্বিগুণ দিলে কাজ হবে। এমনকি আক্রমণ বেশি হলে ১০-১৫ দিন পর পর দুই তিন বার একইভাবে স্প্রে করতে হবে।
লেখক:মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম