আমের ফোস্কা রোগ নিয়ন্ত্রণ
আমের উৎপত্তি এ উপমহাদেশেই। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে আম অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বাণিজ্যিক ফল। এ দেশে ফলের মধ্যে আম চাষের জমি সবচেয়ে বেশি ও উৎপাদনের দিক দিয়ে সব ফলের মধ্যে আমের উৎপাদন তৃতীয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে প্রচুর আম উৎপন্ন হয়। সম্প্রতি পার্বত্য জেলাগুলোতেও আমের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমকে বলা হয় ফলের রাজা। কিন্ত এই রাজকীয় ফসলটিরও রোগ হয়। ক’দিন পরেই আমের মুকুল বের হবে। তখন সেসব মুকুল নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হবে এবং প্রচুর মুকুল হলেও তা থেকে কোনো গুটি হবে না। তাই মুকুল রক্ষা করে আম ধরানোর জন্য এখন থেকেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। মুকুল নষ্ট হয় প্রধানত দু’টি রোগে- ফোস্কা বা অ্যানথ্রাকনোজ রোগ ও সাদা গুঁড়া বা পাউডারি মিলডিউ রোগে। অধিক কুয়াশা ও তীব্র শীতেও আমের মুকুল নষ্ট হয়। তবে ফোস্কা বা অ্যানথ্রাকনোজ রোগে শুধু মুকুলই নষ্ট হয় না, গুটি ও পাকা আমও নষ্ট হয়।
অ্যানথ্রাকনোজ আমের একটি মহাক্ষতিকর রোগ। আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ আম উৎপাদনকারী প্রায় সব দেশেই দেখা যায়। বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, ফিলিপিন, গায়ানা, মরিশাস, ফিজি, ব্রাজিল, কলাম্বিয়া, গুয়াতেমালা, পর্তুগাল, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে অ্যানথ্রাকনোজ একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ। Colletotrichum gloeosporioides নামক ছত্রাক জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়। এ রোগের আক্রমণে প্রায় ২ থেকে ৩৯ শতাংশ আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দেশে সব এলাকার আমগাছেই এ রোগ দেখা যায়।
রোগের লক্ষণ : আমগাছের সব অংশই এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রথমে পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন আকৃতির ছোট ছোট ধূসর বাদামি বা কালো কালো দাগ পড়ে। দাগ পরে বড় হয়। কখনো কখনো দাগের মাঝখানটা ছিঁড়ে বা ফেটে যায়। দাগ শুকনো থাকে বলে এ রোগকে শুকনো ক্ষত রোগও বলা হয়। অধিক আক্রান্ত পাতায় লক্ষণ দেখতে ফোস্কা মতো দেখায়। এ জন্য এর আর এক নাম ফোস্কা রোগ। নার্সারিতে এ রোগের আক্রমণে চারাগাছের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। বয়স্ক পাতার চেয়ে কচি পাতা বেশি আক্রান্ত হয়। অনেক সময় চারার মাথা এ রোগের আক্রমণে মরে শুকিয়ে যায়। লক্ষণ একইভাবে পাতার বোঁটা, মুকুলের ডাঁটা ও ফলের খোসাতেও দাগ পড়ে। তবে এ রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুকুল। আক্রান্ত মুকুল নষ্ট হয় ও শুকিয়ে ঝরে পড়ে। সেসব মুকুলে কোনো গুটি হয় না বা খুব কম হয়। গুটি অবস্থায় ফলের গায়ে ছোট ছোট কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত গুটিআম ঝরে পড়ে। বড় আম আক্রান্ত হলে দাগের স্থানে ত সৃষ্টি হয় ও অনেক সময় তা ফেটে যায়। এ রোগে সম্পূর্ণ আমটাই পচে যেতে পারে।
রোগের বিস্তার : মুকুল ধরা অবস্থায় বৃষ্টি হলে ও কুয়াশা বেশি পড়লে এ রোগ বাড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা রোগাক্রান্ত পাতা, মুকুল ও গুটিআম এ রোগের প্রাথমিক উৎস। গাছে থাকা আক্রান্ত পাতা, মুকুলের ডাঁটি ইত্যাদিও রোগের উৎস। অনুকূল পরিবেশ পেলে এসব আক্রান্ত স্থান থেকে পরের বছর মুকুল এলে সেসব মুকুল আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতাই আসলে পুনঃআক্রমণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি তাপমাত্রা এ রোগ ছড়ানোর জন্য সহায়ক। আর্দ্রতা বেশি থাকলে এ রোগ বেশি হয়। বৃষ্টি ও শিশির এ রোগের জীবাণুর বিস্তার ঘটায়। গাছের কোথাও ক্ষত সৃষ্টি হলে সেসব ক্ষতের মাধ্যমে সহজে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে ও সংক্রমণ সৃষ্টি করে।
রোগ ব্যবস্থাপনা : ভারতে আমের ২০টি জাত নিয়ে গবেষণা করে কোনো জাতই অ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণমুক্ত পাওয়া যায়নি। এ রোগ প্রতিরোধী কোনো জাত পাওয়া যায়নি। তবে যেসব জাতে এ রোগ কম হয় সেসব জাতের আম চাষ করা ও যেসব জাতে বেশি হয় সেসব জাত পরিহার করা যেতে পারে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলি ও আশ্বিনা জাতের আমে এ রোগ বেশি দেখা গেছে, পক্ষান্তরে ল্যাংড়া জাতে দেখা গেছে সবচেয়ে কম।
» এ রোগে আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ফল, পাতা, ডাল গাছের তলায় পড়ে থাকলে সেসব কুড়িয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
» গাছে মুকুল আসার পর মুকুল ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে অর্থাৎ আমের ফুল ফোটার আগেই প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার টিল্ট ২৫০ ইসি বা ১০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন অথবা ২০ থেকে ৩০ গ্রাম ডায়থেন এম৪৫, পেনকোজেব, ইন্ডোফিল এম৪৫ ইত্যাদি ছত্রাকনাশকের যেকোনো একটি ভালোভাবে মিশিয়ে মুকুলে স্প্রে করতে হবে। এমনকি গাছ থেকে আম পাড়ার পর জুন-জুলাই মাসে ডাল-পাতায় একবার স্প্রে করেও সুফল পাওয়া যায়। প্রথমবার স্প্রে করার ১৫ থেকে ২০ দিন পর গুটি মার্বেল আকারের হলে একইভাবে আর একবার স্প্রে করতে হবে। এতে কচি আমে আক্রমণ প্রতিহত হয় এবং আম ঝরে পড়া কমে। কীটনাশকের সাথে এসব ছত্রাকনাশক মিশিয়ে একত্রে স্প্রে করা যেতে পারে। » গাছ থেকে পরিণত আম পাড়ার পর হাতে সহ্য হয় এমন গরম পানিতে (৫১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) আমগুলো ১০ থেকে ১৫ মিনিট চুবিয়ে বাতাসে শুকিয়ে ঝুড়িতে ভরতে হবে।
» আম বাগানে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভালোভাবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়। আম্রপালি জাতে এক পরীক্ষায় ছাঁটাই, আগাছা পরিষ্কার, বাগানের মাটি কোপানো, সুষম সার প্রয়োগ (প্রতি গাছে ১০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ৩৫০ গ্রাম এমওপি, ১০০ গ্রাম জিপসাম ও ১০ গ্রাম জিংক সালফেট সার), মওসুমে ১৪ দিন পর পর সেচ প্রদান, মওসুমে তিনবার ডায়থেন এম৪৫ ছত্রাকনাশক স্প্রে ইত্যাদি কাজ করে অ্যানথ্রাকনোজ নিয়ন্ত্রণ করে সর্বাধিক ফল ধরানো সম্ভব হয়েছে।
লেখক:মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।