আমের ভালো ফলন পেতে রোগ-বালাই প্রতিকার
পাক-ভারত উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। এ জন্য আমকে বলা হয় ফলের রাজা। রাজা হলেও বেড়ে ওঠার সময় অন্যান্য ফলের মতো তাকেও নানা সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। এসব সমস্যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণই প্রধান। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন অনেক কমে যায়। তবে এসব রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য সঠিক বালাইনাশক বা ছত্রাকনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবহার করলে আমের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। আমের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য পরিচর্যা শুরু করতে হবে আমবাগানে মুকুল বের হওয়ার আগেই। গাছে মুকুল আসার কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ দিন আগে পুরো গাছ সাইপারমেথ্রিন বা কার্বারিল গ্রুপের যেকোনো কীটনাশক দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে। তাহলে গাছে বাস করা হপার বা শোষকজাতীয় পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যদি সঠিক সময়ে হপার বা শোষক পোকা দমন করা না যায় তাহলে আমের ফলন কমে যেতে পারে। এমনটি হওয়ার কারণ হলো হপার বা শোষক পোকা আমগাছের কচি অংশের রস চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে। আমের মুকুল বের হওয়ার সাথে সাথে এরা মুকুলকে আক্রমণ করে আমের মুকুল থেকে রস চুষে খেয়ে ফেলে। ফলে মুকুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে। একটি হপার পোকা দৈনিক তার দেহের ওজনের ২০ গুণ রস শোষণ করে খায় এবং দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আঠালো রস মলদ্বার দিয়ে বের করে দেয়, যা মধুরস বা হানিডিউ নামে পরিচিত। এ মধুরস মুকুলের ফুল ও গাছের পাতায় জমা হতে থাকে। মধুরসে এক প্রকার ছত্রাক জন্মায়। এই ছত্রাক জন্মানোর কারণে মুকুল, ফুল ও পাতার ওপর কালো রঙের স্তর পড়ে; যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এই পোকার আক্রমণে শুধু আমের উৎপাদনই কমে যায় না, গাছের বৃদ্ধিও কমে যেতে পারে।
হপার পোকা দমন : আমের ফলন ভালো পেতে হলে অবশ্যই হপার পোকা দমন করতে হবে। হপার পোকা অìধকার বা বেশি ছায়াযুক্ত স্খান পছন্দ করে। তাই নিয়মিতভাবে গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে, যাতে গাছের মধ্যে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে।
আমের মুকুল যখন ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা হয় তখন একবার এবং আম যখন মটর দানার মতো আকার ধারণ করে তখন আরেকবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড বা সিমবুস বা ফেনম বা এরিভো) ১০ ইসি মিশিয়ে পুরো গাছে স্প্রে করতে হবে।
আমের হপার পোকার কারণে যেহেতু সুটিমোল্ড বা ঝুল রোগের আক্রমণ ঘটে তাই রোগ দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সালফারজাতীয় ছত্রাকনাশক হপার পোকা দমনের জন্য ব্যবহার করা কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি মিলডিউ : পাউডারি মিলডিউ এক ধরনের মারাত্মক রোগ। আমাদের দেশে এ রোগের আক্রমণ প্রতি বছর দেখা না গেলেও কোনো কোনো বছর অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করলে রোগটি মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।
পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ প্রধানত আমের মুকুল ও কচি আমে প্রকাশ পায়। প্রথমে আমের মুকুলের শীর্ষ প্রান্তে সাদা বা ধূসর বর্ণের পাউডারের আবরণ দেখা যায়। কচি পাতাতেও রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই পাউডার হচ্ছে ছত্রাক ও তার বীজকণার সমষ্টি। হালকা বৃষ্টি, মেঘলা বা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ এ রোগের জীবাণুর ব্যাপক উৎপাদনে সহায়তা করে। অনুকূল আবহাওয়ায় এই পাউডার সম্পূর্র্ণ মুকুলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত মুকুলের সব ফুল নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্খায় শুধু মুকুলের দণ্ডটি দাঁড়িয়ে থাকে। আক্রমণ মারাত্মক হলে গাছে কোনো ফল ধরে না। তা ছাড়া বেশি আক্রান্ত কচি আম ঝরে পড়ে।
প্রতিকারের উপায় : মুকুল আসার সময় প্রতিদিন (বিশেষ করে মেঘলা আবহাওয়াযুক্ত দিনে) আমগাছ পর্যবেক্ষণ করতে হবে মুকুলে পাউডারি মিলডিউ রোগ দেখা দিয়েছে কি না। রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই সালফার বা গìধকযুক্ত যেকোনো ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
ফলের মাছি পোকা :আমের ভালো ফলন পেতে হলে বাগান ব্যবস্খাপনার দিকে নজর দেয়া জরুরি। বাগান ব্যবস্খাপনা সঠিক না হলে ফলন আশানুরূপ না হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন দেশের সব এলাকার আমগাছে থোকা থোকা কাঁচা আম শোভা পাচ্ছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে এমন আম দেখে চাষি ভাইদের সুখের ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। কারণ আম ঘরে আসতে এখনো অনেক প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফলের মাছিপোকা। হ্যাঁ, ফলের এই মাছি পোকাই আপনার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। আমের বয়স দুই মাস থেকে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত এ পোকা আমের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। বাজারে ভালো দামে আম বিক্রির ক্ষেত্রে এটা বড় সমস্যা। যারা ব্যাপক আকারে আম চাষ করেন তাদের জন্য এটা আরো বড় সমস্যা। কারণ তারা উৎপাদিত আমের বেশির ভাগই রফতানি করেন। পোকায় খাওয়া আম দেশেই বিক্রি করা কঠিন, রফতানি করা তো দূরের কথা।
মাছিপোকা আক্রমণের প্রাথমিক অবস্খায় বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আম পাকার মৌসুমে স্ত্রী মাছি পরিপক্ব আমের গায়ে ডিম পাড়ে। ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে সাদা কিড়া বের হয়। এ অবস্খায় পাকা আম নরম হয়ে গেলে ম্যাগোট আম থেকে বের হয়ে মাটির গর্তে ঢুকে যায় এবং ছয় দিন পর এটি পুত্তলিতে পরিণত হয়। পুত্তলিতে পরিণত হওয়ার ছয় দিন পর এটি পূর্ণাঙ্গ মাছিপোকায় রূপান্তরিত হয়। প্রাথমিক অবস্খায় মাছিপোকার আক্রমণ বুঝা য়ায় না, তবে ভালোভাবে লক্ষ করলে আক্রান্ত আমের গায়ে ডিম পাড়ার স্খানে ক্ষুদ্র ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। ক্ষত স্খানটি কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যায়। আক্রান্ত আম পাকা শুরু হলে আক্রান্ত স্খান থেকে রস ঝরতে দেখা যায়। পাকা আম কাটলে আক্রান্ত আমের শাঁসের ভেতর ১০০ থেকে ১৫০টি সাদা সাদা পোকার কিড়া দেখা যায়। এ পোকায় আক্রান্ত আম অনেক সময় বিকৃত হয়ে যায় বা পচে যায়। এই মৌসুমে মাছিপোকার মাধ্যমে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। কারণ উচ্চতাপমাত্রা ও মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হলে মাছিপোকা তাড়াতাড়ি বড় হয়।
প্রতিকারের উপায় :আম গুটি বাঁধার ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর প্রতিটি আম কাগজ (ব্রাউন পেপার) দিয়ে মুড়িয়ে দিলে আমকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। ছোট গাছের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি সহজেই ব্যবহার করা যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমের রসের সাথে এক গ্রাম ডিপটেরেক্স মিশিয়ে বিষটোপ বানিয়ে এ বিষটোপ বাগানে রেখে মাছি পোকা দমন করা যেতে পারে। আম পাকার মৌসুমে আমবাগানে ব্লিচিং পাউডার (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম) স্প্রে করে মাছি তাড়ানো যেতে পারে। আম পাকার মৌসুমে প্রতিটি আম কাগজ (ব্রাউন পেপার) দিয়ে মুড়িয়ে দিলে আমকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যাবে। আমবাগানে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
পরগাছা উদ্ভিদ : আমাদের দেশে আমগাছে দু-তিন প্রকার পরগাছা উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায়। স্খানীয়ভাবে পরগাছা উদ্ভিদ ধ্যারা নামে পরিচিত। ছোট গাছের চেয়ে বড় বা বয়স্ক আমগাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়। পরগাছা উদ্ভিদের বীজ আমগাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে। পরগাছা ডাল থেকে প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার শিকড় থাকে না, তারা শিকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া তৈরি করে। হস্টোরিয়া গাছের ডালে প্রবেশ করে ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আক্রান্ত ডালের প্রায় সব খাবার পরগাছা খেয়ে ফেলে। ফলে আক্রান্ত ডাল দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে আম ডালের অস্তিত্ব থাকে না বরং পরগাছা প্রভাব বিস্তার করে বাড়তে থাকে। লরানথাসজাতীয় পরগাছার পাতা দেখতে কিছুটা আমপাতার মতোই। তাই ভালোভাবে লক্ষ না করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্খিতি বোঝা যায় না। তবে পরগাছায় ফুল ও ফল ধরলে দূর থেকে পরগাছার উপস্খিতি বোঝা যায়। এ সময় পরগাছা ফুল ফুটন্ত অবস্খায় থাকে। ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পরগাছা আকর্ষণীয় ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। বীজসহ ফল পাখিরা খায়, কিন্তু বীজ হজম না হওয়ায় তা মলের সাথে বের হয়ে আসে। এ বীজ আমের ডালে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয় ও বাড়তে থাকে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকারের উপায় : আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা স্খানে রোগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দো পেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল-ফল আসার আগেই পরগাছা ছাঁটাই করা উচিত।
ওপরে যেসব সমস্যার কথা বলা হলো আম চাষে কেবল এরাই সমস্যা তৈরি করে, তা নয়। আরো অনেক সমস্যা আছে। সঠিক সময়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমের ভালো ফলন পাওয়া যায়। যারা আম চাষ করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ছেন বা পড়েছেন তারা সঠিক পরামর্শের জন্য ০৭৮১-৫৫৪৭২ অথবা ০১৭১২১৫৭৯৮৯ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
এগ্রোবাংলা ডটকম
আমের মহালাগা : কারণ ও করণীয়
আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর অন্যতম হলেও আম চাষে রয়েছে নানা সমস্যা। তারমধ্যে বিভিন্ন রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকা-মাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এই রোগ ও পোকা-মাকড় দমনের সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন করে নির্দিষ্ট মাত্রায় সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। আম বাগানে মুকুল বা পুস্পমঞ্জুরী বের হওয়ার আনুমানিক ১৫-২০ দিন আগে সাইপারমেথ্রিন, কার্বারিল, ইমিডাক্লোরোপিড, সাইহ্যালাথ্রিন গ্রুপের যে কোনো কীটনাশক দিয়ে ভালভাবে সমস্ত গাছে স্প্রে করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে গাছে বসবাসকারী হপার বা শোষক পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ হবে না। যদি সঠিক সময়ে হপার পোকা দমন করা না যায় তাহলে আমের মুকুল বের হওয়ার সাথে সাথে এগুলো মুকুলকে আক্রমণ করে। এই পোকার আমের মুকুল থেকে রস চুসে খায় ফলে মুকুল শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। পরে শুধু গাছে আম শূন্য মুকুল দেখা যায়। একটি হপার পোকা দৈনিক তার দেহের ওজনের ২০গুন পরিমাণ রস খায় এবং দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আঠালো রস মলদ্বার দিয়ে বের করে যা মধুরস নামে পরিচিত। এ মধুরস মুকুলের ফুল ও গাছের পাতায় জমা হয়। পরে এ থেকে জন্ম নেয় এক প্রকার ছত্রাক। এর ফলে মুকুল, ফুল ও পাতার উপর কালো রংয়ের স্তর পড়ে যা সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। ছত্রাকের এ আক্রমণকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় স্থানীয়ভাবে মহালাগা বলে। চলতি মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ার পর এই ছত্রাকের আক্রমণ সেখানে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে অন্যান্য এলাকাতেও এর বিস্তার ঘটে। তবে বৃষ্টি হওয়া মাত্রই এর আক্রমণ কমবে। এই পোকার আক্রমণে আমের উৎপাদন শতকরা ১০০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
দমন পদ্ধতি : ১. হপার পোকা অন্ধকার বা বেশি ছায়াযুক্ত স্থান পছন্দ করে তাই নিয়মিতভাবে গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যাতে গাছের মধ্যে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে।
২. আমের মুকুল যখন ৮ থেকে ১০ সে. মি. হয় অর্থাৎ ফুল ফোটার আগে একবার এবং আম যখন মটর দানাকৃতি হয় তখন আর একবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি লিটার হারে সাইপারমেথ্রিন ১০ইসি, ডেসিস ২.৫ইসি, কার্বারিল, ইমিডাক্লোরোপিড, সাইহ্যালাথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ভালভাবে মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ স্প্রে করতে হবে।
৩. আমের হপার পোকার কারণে সুটিমোল্ড বা ঝুল রোগের আক্রমণ ঘটে। রোগ দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক হপার পোকা দমনের জন্য ব্যবহার্য কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
লেখক: মো: শরফ উদ্দিন কৃষিবিদ
আমের গুরুত্বপূর্ণ রোগ
আম খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ একটাই- আম অনেক সুস্বাদু ফল। আমকে তাই ফলের রাজা বলা হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ বেশ জনপ্রিয়। অনেকে বাড়িতে সখ করে আমগাছ লাগিয়ে থাকে। যাদের বাড়িতে আমগাছ আছে কিংবা যিনি প্রথমবারের মত আমের চাষ করছেন তারা প্রথমদিকে বেশ কিছু বিষয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন, যেমন- আম মুকুল হয়ে প্রতিবছরই সব মুকুল ঝরে পড়ে, পাতায় অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক দাগ দেখা যায়, আমের অঙ্গ বিকৃতি কিংবা আম সংগ্রহ করার পর বোঁটায় পচন ধরাসহ ইত্যাদি। এসব বিড়ম্বনা থেকে আগেভাগেই আম এবং আমগাছ বাঁচাতে হলে আমের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রোগ সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই প্রয়োজন।
আমের আনথ্রাকনোজ:
লক্ষণ: ১. পাতায়, কাণ্ডে, মুকুলে ও ফলে এই রোগ দেখা যায়;
২. পাতায় অনিয়মিত দাগ দেখা যায় যেগুলো পরে বাদামী থেকে কালো হয়ে বড় বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং পাতা ঝরে যায়;
৩. মুকুল কালো হয়ে যায় এবং গুটিগুলো পড়ে যায়;
৪. পাকা আমে স্পষ্ট দাগ দেখা যায় যা পরবর্তীতে বড় হয়ে আমে পচন ধরায়।
দমন: ১. মুকুল আসার আগে টিল্ট ২৫০ ইসি- ০.৫ মিলিলিটার/ লিটার বা ডায়থান এম ৪৫ -২ গ্রাম/লিটার সেপ্র করতে হবে;
২. বোরডোয়াক্স মিশ্রণের ১% দ্রবণ ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ বার সেপ্র করতে হবে।
বোঁটা পচা রোগ:
লক্ষণ: ১. সবচেয়ে মারাত্মক রোগ, প্রথমে বোঁটার দিকে পচন ধরে পরে পুরো ফলটি পচে গিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করে;
২. প্রথমে গাছে থাকা অবস্থায় জীবাণুটি মুক্ত অবস্থায় থাকে পরে আম সংগ্রহের পরে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হলে আক্রান্ত আমের পাল্পগুলো বাদামী হয়ে যায় যা আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না।
দমন: ১. প্রায় ২-৩ সে.মি. বোঁটা রেখে আম সংগ্রহ করতে হবে;
২. ডায়থান এম ৪৫ অথবা বেভিসটিন (০.২%) সেপ্র করতে হবে।
পাউডারি মিলডিউ:
লক্ষণ: ১. আক্রান্ত আম গাছের পাতায় সাদা পাউডারের মত গুঁড়ো দেখা যায়, পরে আক্রান্ত স্থানের টিস্যুগুলো মারা যায় এবং কালো বর্ণ ধারণ করে,
২. আক্রান্ত আমের মুকুল বা গুটি ঝরে পড়ে।
দমন: ১. থিওভিট বা সালফার জাতীয় যেকোনো ছত্রাকনাশক (০.২%) ব্যবহার করতে হবে।
স্যুটি মোল্ড:
লক্ষণ: ১. পাতা, ফল, মুকুল আক্রান্ত হলে কালো কালো দাগ পড়ে যায়।
দমন: ১. স্যুটি মোল্ড দমনে সালফার (৪ গ্রাম/লিটার) ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমের অঙ্গ বিকৃতি বা ম্যালফরমেশন:
লক্ষণ: ১. এটা সাধারণত মুকুলে হয় তবে ডালের আগায়ও হতে পারে;
২. আক্রান্ত মুকুল কালো হয়ে যায় এবং মুকুলগুলো একীভূত হয়ে জটলার সৃষ্টি করে।
দমন: ১. আম ধরার ৮০ থেকে ৯০ দিন আগে ন্যাপথেলিক এসিটিক এসিড সেপ্র করতে হবে;
২. আক্রান্ত স্থানে কার্বোন্ডাজিম (১ গ্রাম/ লিটার পানি) সেপ্র করতে হবে।
এগ্রোবাংলা ডটকম
আমের পোকা ম্যাঙ্গো উইভিল
প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জেলায় আমের ভেতর পোকা দেখা যায়। আমের বাইরে খোসা দেখে মনে হয় ভেতরে কোনো সমস্যা নেই। অথচ আম পাকার পর তা কাটলে তার ভেতরে দেখা যায় পোকা কিলবিল করছে। এ পোকা একবার আমের ভেতরে ঢুকে গেলে কোনোভাবেই দমন করা সম্ভব নয়। তাই মুকুল আসার সময় এ পোকা দমন করতে হবে। যে আম গাছে একবার ওই পোকা দেখা যাবে সে গাছে প্রতিবছরই এ পোকার আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি আশেপাশের আরো আমগাছে এ পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এ পোকা দমন করতে হবে মুকুল ধরার আগে কিংবা মুকুল ধরার সময়।
আমের ভেতর ম্যাঙ্গো উইভিল নামের এ পোকা আমের ক্ষতি করে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হল আমের ত্বকে কোনো ছিদ্র থাকে না। এত বড় পোকা কীভাবে আমের ভেতর ঢুকে এবং বেঁচে থাকে তা সত্যিই অবাক করার মত। আমের যখন মুকুল আসে, তখন এ পোকা মুকুলে ডিম পাড়ে। মুকুল থেকে কচি আম হওয়ার সময় ফুলের ভেতরই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে কচি আমের ভেতর আস্তে আস্তে ঢাকা পড়ে। আমের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরের পোকাও বড় হতে থাকে। পোকাগুলো দিন দিন বেড়ে ওঠে আম খেয়ে। সাধারণত মুকুল ধরার সময় তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা একটু বেশি এবং উচ্চ আর্দ্রতা থাকলে এ পোকা আক্রমণ করার আশঙ্কা বেশি থাকে। এক বছর আক্রমণ করলে প্রতিবছরই এ পোকা আক্রমণ করে। আমের ভেতর পোকা ঢুকে গেলে দমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি দমনের জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন মিশিয়ে মুকুল ধরার সময় মুকুলে স্প্রে করতে হবে। অথবা ৩০ মিলিলিটার ডায়াজিনন বা ১৫ মিলিলিটার ডাইমেক্রন প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে মুকুলে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া আমগাছের নিচে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ডিমের গাদা নষ্ট করতে হবে। আক্রান্ত আমগাছের নিচে পড়ে থাকা পাতা ও মুকুল পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মুকুল ধরার সময় এলাকার সব আক্রান্ত গাছে একসঙ্গে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। অন্যথায় যে গাছে স্প্রে করা হবে না, সেই গাছে অন্য গাছ থেকে পোকা আক্রমণ করবে। এ ছাড়া আমের ফলন বাড়াতে হলে বছরে অন্তত দু’বার সুষম মাত্রায় সার দিতে হবে। সেচ দিতে হবে প্রতি মাসে একবার। অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে দিতে ধরা। আমগাছের স্বভাব হচ্ছে প্রতি ডালে এক বছর পর পর আম ধরে। এ জন্য কোনো গাছে এক বছর ফলন ভাল হলে অন্য বছর ফলন কম হয় অথবা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।