সম্ভাবনার ফল ড্রাগন
ড. জে সি মালাকারড্রাগন ক্যাকটাস গোত্রের একটি ফল। ড্রাগন ফলের গাছ লতানো ইউফোরবিয়া গোত্রের ক্যাকটাসের মতো; কিন্তু এর কোনো পাতা নেই। গাছ দেখে সবাই একে চিরসবুজ ক্যাকটাস বলেই মনে করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম ড্রাগন ফল ২০০৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্রবর্তন করেন। প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম এ ফলের জাত নিয়ে আসেন থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে। ড্রাগন ফলের (Hylocereus undatus) উৎপত্তিস্থল সেন্ট্রাল আমেরিকা। ভিয়েতনামে এ ফল সর্বাধিক বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।
ড্রাগন ফুল রাতের রানি ড্রাগন গাছে ফুল ফোটে রাতে। দেখতে অনেকটা নাইট কুইন ফুলের মতো, লম্বাটে, সাদা ও হলুদ। ড্রাগন ফুলকে ‘রাতের রানি’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ফুল স্বপরাগায়িত; তবে মাছি, মৌমাছি ও পোকা-মাকড়ের পরাগায়ণ ত্বরান্বিত করে এবং কৃত্রিম পরাগায়ণও করা যেতে পারে।
আবহাওয়া ও জমি নির্বাচন ড্রাগন ফল প্রচুর আলো পছন্দ করে। এ ফলটির জন্য শুষ্ক ট্রপিক্যাল আবহাওয়া প্রয়োজন। মধ্যম বৃষ্টিপাত এ ফলের জন্য ভালো। উপযুক্ত বৃষ্টিপাতে ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলের পচন দেখা দেয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। তবে পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে এ ফলের চাষ করা ভালো। উচ্চ জৈব পদার্থসমৃদ্ধ বেলে-দোঁআশ মাটিই এ ফল চাষের জন্য উত্তম।
উপযোগী জাত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে অবমুক্তায়িত বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা) বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল) চাষ করা যেতে পারে। এ ছাড়া হলুদ ড্রাগন ফল ও কালচে লাল ড্রাগন ফলও চাষ করা যেতে পারে।
রোপণ পদ্ধতি জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৩ মিটার এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩ মিটার দিয়ে এ গাছ লাগানো উত্তম। তবে অবস্থাভেদে দূরত্ব কম বা বেশি দেওয়া যেতে পারে ।
গর্তপ্রতি সারের মাত্রা ও সার ব্যবস্থাপনা ড্রাগন ফলের চারা রোপণের জন্য ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি ১০০ গ্রাম করে এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম করে দিয়ে গর্তের মাটি ওপরে-নিচে ভালোভাবে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। সার দেওয়ার ২০ থেকে ৩০ দিন পর গাছ লাগানো যাবে। এর পর প্রতিবছরে গাছের জন্য ৪০ কেজি পচা গোবর ঠিক রেখে ইউরিয়া ৫০ গ্রাম, টিএসপি ও এমপি ১০০ গ্রাম করে এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম করে বৃদ্ধিহারে প্রয়োগ করতে হবে। ক্যাকটাস গোত্রের গাছ বিধায় বছরের যেকোনো সময়ই লাগানো যায়; তবে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে লাগানো ভালো। কাটিং করা কলমপ্রতি গর্তে ৪-৫টি করে লাগানো হয়। পিলারের চারদিকে কাটিং করা কলম চারা লাগিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওপরের দিকে ছোট মোটর গাড়ির (মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার) চাকা বাঁশের চাগারের মধ্যে সেট করে খুব সহজেই এ গাছের শাখাগুলোকে বাড়তে দেওয়া যায়। দুই খুঁটি পুঁতে মোটা তারের ওপরে জাংলার মতো তৈরি করে গাছ জাংলায় তুলে চাষ করা হয়।
পরিচর্যা : চারা লাগানোর পর খুঁটি বা পিলার পুঁতে দিয়ে ড্রাগন ফল গাছ বেঁধে দিতে হবে। কেননা ড্রাগনের গাছের কান্ড লতানো প্রকৃতির। তিনটি পদ্ধতিতে খুঁটি দিয়ে গাছটি সাপোর্ট দিতে হয়।
ক. ভিয়েতনাম পদ্ধতি,
খ. ফ্লোরিডা পদ্ধতি,
গ. শ্রীলঙ্কা পদ্ধতি।
ভিয়েতনাম পদ্ধতি : এ ক্ষেত্রে পিলারের চারদিকে কাটিংকৃত কলম চারা লাগিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়।
ফ্লোরিডা পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে দুই পাশে দুটি খুঁটি পুঁতে মোটা তারের উপর জাংলার মতো তৈরি করে গাছ জাংলায় তুলে দিতে হয়।
শ্রীলঙ্কা পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে পিলার পুঁতে দিয়ে চারা লাগিয়ে দিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। পিলারের চার দিকে বাঁশের চ্যাগারের উপরে মোটর গাড়ির পুরাতন টায়ার দিয়ে তার উপর গাছের শাখাগুলোকে বাড়তে দেয়া হয়।
কাটিংয়ের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ড্রাগন ফলের বংশ বিস্তার অত্যন্ত সহজ। বীজ দিয়েও বংশ বিস্তার করা যেতে পারে। এতে ফল ধরতে একটু বেশি সময় লাগে এবং হুবহু মাতৃগুণ বজায় থাকে না। সে জন্য কাটিংয়ের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করাই উত্তম। কাটিংয়ের সফলতার হার প্রায় শত ভাগ এবং ফল তাড়াতাড়ি ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত একটি গাছে ফল ধরতে ১২-১৮ মাস সময় লাগে। সাধারণত বয়স্ক এবং শক্ত শাখা কেটে (১-১.৫ ফুট) হালকা ছায়ায় বেলে-দোআঁশ মাটিতে গোড়ার দিকের কাটা অংশ পুঁতে সহজেই চারা উৎপাদন করা যায়। ২০ থেকে ৩০ দিন পরে কাটিংয়ের গোড়া থেকে শিকড় বেরিয়ে আসবে এবং তখন কাটিং মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হবে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী কাটিং করা কলম সরাসরি মূল জমিতে লাগানো যায়।
গাছের আকার ও শাখা-প্রশাখা কর্তন ড্রাগন ফল গাছ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মোট শাখা তৈরি করে। একটি এক বছরের গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে। তবে শাখা-প্রশাখা উৎপাদন গাছের আকার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১২-১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। ফল সংগ্রহের পর ৪০-৫০টি প্রধান শাখায় প্রত্যেকটিতে এক-দুটি সেকেন্ডারি শাখা অনুমোদন করা হয়। গাছের আকার ও শাখা-প্রশাখা কর্তনের কার্যক্রম দিনের মধ্যভাগে করাই ভালো। কর্তন করার পর অবশ্যই যেকোনো ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে।
সেচ ব্যবস্থাপনা ড্রাগন ফল গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না এবং এ ফল চাষে পানি খুব কম লাগে। শুষ্ক মৌসুমে অবশ্যই সেচ ও বর্ষা মৌসুমে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই সারির মাঝখানে ৫০-১০০ সেন্টিমিটার আকারে নালা তৈরি করা যেতে পারে। এতে করে নালায় এক-দুই দিন পানি জমা রেখে গাছের মাটিতে রস সরবরাহ করা যেতে পারে।
অসময়ে ফল উৎপাদনের কলাকৌশল বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে পরীক্ষামূলক চাষে দেখা গেছে, ফল আসা শুরু হয় জুন মাসে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। শীতকালে দিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে প্রতি চারটি গাছের জন্য একটি করে ৬০-১০০ ওয়াটের বাল্ব সন্ধ্যা থেকে ৫-৬ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রেখে ফল আনা হচ্ছে এবং চাহিদা মোতাবেক সময়ে ফল নেওয়া যায়।
নতুন অতিথি ড্রাগন ফ্রুট
এক শৌখিন ফলচাষি বাণিজ্যিকভাবে এ দেশে প্রায় ১০ একর জমিতে ড্রাগন ফন্সুটের চাষ করে হইচই ফেলে দিয়েছেন। ঢাকার সাভারে আশুলিয়ার মরিচাকাটা গ্রামে রুম্পা চক্রবর্তী ড্রাগন ফ্রুটের সাড়ে ষোলো হাজার গাছ লাগিয়ে ইতোমধ্যেই সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই সেসব গাছ ফলবতী হয়ে উঠেছে। এ বছরই তিনি প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার ফল পাওয়ার আশা করছেন। তিনি বলেন, যেসব দেশ ড্রাগন ফলের দেশ হিসেবে পরিচিত, সেই থাইল্যান্ডেও গাছ পূর্ণ ফলবান হতে প্রায় তিন বছর লাগে। বাংলাদেশে তিনি ২০০৯ সালে থাইল্যান্ড থেকে ড্রাগন ফন্সুটের চারা এনে লাগান। সেসব গাছে মাত্র এক বছরের মধ্যে ফল ধরতে দেখে তিনি নিজেও বেশ অবাক। তাই তিনি রফতানিযোগ্য এ ফলের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে বেশ আশাবাদী। দেশে এখন এই ফলের চারাও পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রুট জার্ম প্লাজম সেন্টারে। সাভারের জিরানীতেও বানিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এই ফল। এল আর অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান গড়ে তুলেছেন এই বাগান।
ফলটা আসলে কী? ড্রাগন ফ্রুট বা ড্রাগন ফল একধরনের ক্যাকটাসগাছের ফল। এ ফলের অন্য নাম পিটাইয়া। চীনে এই ফলের নাম হুয়ো লং গুয়ো, ভিয়েতনামে থানহ লং। ড্রাগন ফলের জন্ম মধ্য আমেরিকায়। দক্ষিণ এশিয়ার মালয়েশিয়ায় ফলটি প্রবর্তিত হয় বিংশ শতাব্দীর দিকে। বর্তমানে ভিয়েতনামে ফলটি বেশি চাষ হচ্ছে। ভিয়েতনাম ছাড়াও তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, চীন, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়াতেও চাষ হচ্ছে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম ড্রাগন ফলের গাছ নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্ম প্লাজম সেন্টারে প্রফেসর ড. এম এ রহিম গবেষণার উদ্দেশ্যে ড্রাগন ফলের কয়েকটি জাত নিয়ে আসেন থাইল্যান্ড থেকে। সেসব গাছ দিব্যি ফল দিচ্ছে। এই সফলতার ওপর ভিত্তি করে সেন্টার থেকে এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ড্রাগন ফলের চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গাছের বর্ণনা : ড্রাগন ফলের গাছ এক রকমের ক্যাকটাস। গাছ লতানো। গাছে কোনো পাতা নেই। গাছ ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হয়। সবুজ রঙের এই গাছে খুব সুন্দর সাদা ও সবুজাভ সাদা রঙের ফুল ফোটে। ফুল দেখতে অনেকটা ‘নাইট কুইন’-এর মতো। ফুল সুগìধযুক্ত ও স্বপরাগায়িত। ফুল বেশ বড়। ড্রাগন ফুলকে বলা হয় ‘মুন ফ্লাওয়ার’ বা ‘কুইন অব দ্য নাইট’। ফুল থেকে ডিম্বাকার ফল গঠিত হয়। ফলের খোসা নরম। একটি ফলের ওজন ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম। কখনো কখনো ফলের ওজন এক কেজি পর্যন্ত হয়। পাকা ফলের শাঁস বেশ নরম, কালোজিরার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো রঙের অসংখ্য বীজযুক্ত, হালকা মিষ্টি, ক্যালরি খুব কম।
পুষ্টিমূল্য : ড্রাগন ফলের ১০০ গ্রামের মধ্যে ৫৫ গ্রাম থাকে ভক্ষণযোগ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে থাকে পানি ৮০ থেকে ৯০ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৯ থেকে ১৪ গ্রাম, প্রোটিন ০.১৫ থেকে ০.৫ গ্রাম, চর্বি ০.১ থেকে ০.৬ গ্রাম, আঁশ ০.৩ থেকে ০.৯ গ্রাম, অ্যাশ ০.৪ থেকে ০.৭ গ্রাম ও ক্যালরি ৩৫ থেকে ৫০। এ ছাড়া খনিজ ও ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্যালসিয়াম ৬-১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৩-০.৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৬-৩৬ মিলিগ্রাম, নায়াসিন ০.২-০.৪৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৪-২৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ও রিবোফ্লাভিন থাকে খুব অল্প। লাল শাঁসের ড্রাগন ফলে ভিটামিন সি থাকে বেশি। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভাতের পরিবর্তে এ ফল উত্তম। তাইওয়ানের ডাক্তাররা ডায়াবেটিক রোগীদের ভাতের বদলে এ ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এমনকি এ ফল রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ফলের শাঁস পিচ্ছিল হওয়ায় তা কেষ্ঠ্যকাঠিন্যও দূর করে।
ফলের ব্যবহার : ফিন্সজে রেখে ঠাণ্ডা করে খেলে বেশি ভালো লাগে। ফল থেকে রস তৈরি করা যায়। এর ফুলও খাওয়া হয়। খাওয়ার জন্য ফলকে চাকু দিয়ে লম্বালম্বিভাবে দুই ফালি করে ফেলা হয়। তারপর চামচ দিয়ে কুরে কুরে নরম শাঁস তুলে খাওয়া যায়। এ ছাড়া খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া যায়। বীজসহ শাঁস খাওয়া হয়। বীজ চিবিয়ে না খেলে তা কখনো হজম হয় না। এমনকি পরিমাণে বেশি খেলে এ ফল সহজে হজম হয় না। বিশেষ করে লাল শাঁসবিশিষ্ট ড্রাগন ফলগুলো খাওয়ার পর প্রস্রাবের রঙও লাল হয়ে যায়।
জাত : ড্রাগন ফল আছে দুই রকমের টক স্বাদের ও মিষ্টি স্বাদের। মিষ্টি স্বাদের ফলবিশিষ্ট ড্রাগন ফলের আবার তিনটি প্রজাতি রয়েছে : লাল ড্রাগন ফল বা পিটাইয়া। এ প্রজাতির গাছের ফলের খোসার রঙ লাল, শাঁস সাদা। এ প্রজাতির ফলই বেশি দেখা যায়। কোস্টারিকা ড্রাগন ফল। এ ফলের খোসা ও শাঁসের রঙ লাল। হলুদ ড্রাগন ফল। এ ফলের খোসা হলুদ রঙের ও শাঁসের রঙ সাদা।
Stenocereus ড্রাগন ফল স্বাদে টক, এগুলো টক ড্রাগন ফল বা ‘সাওয়ার পিটাইয়া’ নামে পরিচিত। আমেরিকার ঊষর অঞ্চলে এগুলো পাওয়া যায়। খুব টক বলে মেক্সিকো ও আমেরিকার লোকরা ওই ড্রাগন ফলের রসকে বিভিন্ন শরবত তৈরিতে কাজে লাগায়, কাঁচা বা তাজা ফল খায় না।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য বাউ ড্রাগন ফল-১ ও বাউ ড্রাগন ফল-২ নির্বাচন করা যেতে পারে। প্রথম জাতটির শাঁস সাদা, দ্বিতীয় জাতটির শাঁস লাল।
জলবায়ু ও মাটি : ড্রাগন ফলের জন্য শুষ্ক জলবায়ু দরকার। মাঝারি বৃষ্টিপাত ভালো। তবে অধিক বৃষ্টি হলে ফুল ঝরে যায় ও ফলে পচন দেখা যায়। পানি জমে না এমন উঁচু যেকোনো মাটিতে ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। রোদ, খোলামেলা জায়গা ও প্রচুর জৈবসারে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।
চারা তৈরি : ড্রাগন ফলের চারা তৈরি খুব সহজ। বীজ দিয়ে চারা তৈরি করা যায়। তবে সেসব চারায় ফল ধরতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই কাটিং করে শাখা কলম করে চারা তৈরি করা উত্তম। বয়স্ক ও শক্ত শাখা এক থেকে দেড় ফুট লম্বা ও তেরছা করে কেটে বালি বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে বসিয়ে দিলে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তা থেকে শিকড় গজায়। তবে কাটিং রাখার জায়গায় শেড বা ছায়ার ব্যবস্খা করতে হবে। মাটিতেও রস থাকতে হবে। কাটিং সাধারণত মরে না। কাটিংয়ের গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত গাছে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করে।
জমি তৈরি ও রোপণ : জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে সমান করে তিন মিটার পরপর সব দিকে সারি করে চারা লাগানো যেতে পারে। চারা রোপণের মাসখানেক আগে গর্ত তৈরি করে তা সারমাটি দিয়ে ভরে রেখে দিতে হবে। প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার, ১০ গ্রাম করে জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট ও বোরাক্স সার দেয়া যেতে পারে। বছরের যেকোনো সময় চারা লাগানো যেতে পারে। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাগালে ভালো হয়। প্রতি গর্তে চার থেকে পাঁচটি চারা লাগাতে হবে। সিমেন্ট বা বাঁশের খুঁটির সাথে গাছ লতিয়ে দিতে হবে।
ছাঁটাই : ড্রাগন ফলগাছ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। একটি এক বছর বয়সী গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে। চার বছর বয়সী গাছ ১৩০টি শাখা তৈরি করে। এ দেশে রোপণের ১২ থেকে ১৮ মাস পর ফল ধরতে শুরু করে। ফল তোলা শেষে প্রতিটি গাছের ৪০ থেকে ৫০টি শাখার প্রত্যেকটিতে ১ থেকে ২টি প্রশাখা রেখে বাকিগুলো ছেঁটে দিতে হবে। ছেঁটে দেয়ার পর ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
সেচ : ড্রাগন ফলের গাছে তেমন সেচ লাগে না। তবে শুষ্ক মৌসুমে মাটি শুকিয়ে গেলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে। দুই সারির মাঝে পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই নালা রাখতে হবে। এসব নালার মুখ আটকে মাঝে মধ্যে পানি ভরে রেখে দিলে সেখান থেকে গাছের শিকড় পানি পায়। তবে লক্ষ রাখতে হবে, এ গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না। তাই জমিতে যেন পানি জমে না থাকে।
ফলন : ১২ থেকে ১৮ মাস বয়সের একটি গাছে ৫ থেকে ২০টি ফল পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক একটি গাছে ২৫ থেকে ১০০টি ফল পাওয়া যায়। হেক্টরপ্রতি ফলন ২০ থেকে ২৫ টন।
বালাই ব্যবস্খাপনা : নতুন আসা এ ফলের গাছে তেমন কোনো রোগ ও পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যয়নি। তবে কখনো কখনো শিকড় পচা, কাণ্ড ও গোড়া পচা রোগে গাছ আক্রান্ত হয়।
মূল পচা : গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে গেলে মূল পচন দেখা দেয়। গাছকে টান দিলে মূল ছাড়া উঠে আসে। এজন্য উঁচু জমিতে চাষ করতে হবে। যেখানে গোড়ায় পানি জমে না।
কান্ড ও গোড়া পচা রোগ : ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয় এ রোগ হলে কা- প্রথমে হলুদ রঙ পরে কালো রঙ ধারণ করে। পরে ওই অংশে পচন শুরু এবং পচার পরিমাণ বাড়তে পারে। এ রোগ দমনের জন্য ছত্রাকনাশক যেমন- বেভিস্টিন, রিকোমিল, থিওভিট ইত্যাদির যে কোনো একটি ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
পোকা মাকড় : ড্রাগন ফলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় খুব একটা চোখে না পড়লেও মাঝে মধ্যে এফিড ও মিলি বাগের আক্রমণ দেখা যায়। এরা গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায়, ফলে রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ পোকা দেখা দিলে সুমিথিয়ন বা ডেসিস বা ম্যালাথিয়ন প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মি.লি. ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম