লটকন চাষ
এ দেশের একটি অপ্রচলিত ও খাদ্যমানে সমৃদ্ধ ফল হচ্ছে লটকন। এ ফলটি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি এর চাষও লাভজনক। তবে এটি চাষ করতে বাড়তি কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আঙিনায় বা বড় বড় গাছের নিচে অধিক ছায়াযুক্ত জায়গায় খুব সহজেই লটকনের আবাদ করা যায়। লটকন চারা রোপণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন নার্সারি থেকেই লটকন চারা সংগ্রহ করা যায়। লটকন গাছ রোপণের তিন-চার বছর পর থেকেই গাছে ফল ধরতে শুরু করে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে লটকন গাছে ফুল আসে। তাই গাছে ফুল আসার আগে মার্চ মাসে গাছটির গোড়ার মাটি সামান্য কুপিয়ে তাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিলে ফলন যেমন অনেকগুণ বৃদ্ধি পায় তেমনি ফলগুলোও আকারে বড় হয়। তবে লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। কিন্তু লটকন গাছ অধিক ছায়াযুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠায় মাঝে-মধ্যে এ গাছে ছত্রাক জাতীয় আবরণ পড়ে থাকে। তখন ফলের ওপর ছত্রাকনাশক ওষুধ ছিটিয়ে ছত্রাক থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। এতে ফলের রঙও উজ্জ্বল হয়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে লটকন গাছে ফুল এলেও জুলাই মাসের প্রথম থেকেই ফল পাকতে শুরু করে। ফল পাকলে এর পরিপক্বতা অনুযায়ী ছড়া ছড়া ফল সংগ্রহ করা উচিত। লটকন ফলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত এমনভাবে ফল ধরে যে, তাতে গাছের কা- বা ডাল অনেক সময় দেখা যায় না। আর একটি বিষয় হচ্ছে লটকন পাকার ৫০-৬০ দিন আগে গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা বেড়ে থাকে। এই লটকন চাষ খুবই লাভজনক। একটি ১০ বছরের লটকন গাছে গড়ে প্রায় ২০০ কেজি লটকন ধরে। লটকন ফল গোলাকার এবং পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। তখন এ ফলটি সবারই মন কেড়ে নেয়। ফল হিসেবে লটকন যেমন খাদ্যমানে ভরপুর তেমনি ক্যালসিয়াম, ক্যারোটিন ও খনিজ লবণে সমৃদ্ধ। বর্তমানে আমাদের দেশের বাজারে লটকনের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও ইউরোপের দেশগুলোতেও লটকন রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তাই পারিবারিক চাহিদা পূরণ ও বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে আমাদের উচিত লটকন চাষের প্রতি গুরুত্ব দেয়া।
লেখক: খন্দকার এরফান আলী বিপ্লব
বাংলায় ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ বলে একটি কথা আছে। তেমনি এ দেশে বারো মাসে ফলও আছে হরেক রকমের। এসব মৌসুমি ফলের জন্য গ্রীষ্মের খ্যাতিই শীর্ষে—সে কথা সবার জানা। গ্রীষ্ম বিদায় নিলেও তার ফলের সম্ভার এখনো ফুরায়নি বাজারে। লিচু ঢের আগেই উঠে গেছে বাজার থেকে। আম-কাঁঠাল এখনো ফলের বাজারে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তবে লিচু-জাম-জামরুলের শূন্যস্থান পূরণ করতে এসে গেছে বর্ষার পেয়ারা, আনারস, লটকন প্রভৃতি।
বাংলার ফলসম্ভারের মধ্যে লটকনও সুগোল ফলের অন্যতম। আকারে অবশ্য জাবুলানির মতো নয়, বরং মার্বেলের চেয়ে খানিকটা বড়। হলুদ রঙের ফলগুলো লম্বা বৃন্তের সঙ্গে গুচ্ছাকারে সন্নিবেশিত থাকে। কাঁচা অবস্থায় অবশ্য এর রং সবুজ। লিচু গোনাগুনতির হিসাবে বিক্রি হলেও ঢাকায় লটকন বিক্রি হয় ওজন করে। খুচরা দাম ৬০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি। এক কেজিতে আকারভেদে ২৫ থেকে ৭০টি পর্যন্ত হয়। নরসিংদীর ওদিকটাতেই লটকনের ফলন বেশি। এ ছাড়া সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুর—এসব জেলায়ও ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে নরসিংদীর বেলাব এলাকা এখন লটকনের গ্রাম বলেই পরিচিত হচ্ছে বলে কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় উল্লেখ করেছেন তাঁর বাংলার বিচিত্র ফল নামের বইতে।
লটকন আমাদের দেশি ফল। অঞ্চলভিত্তিক এর বেশ কিছু স্থানীয় নাম আছে। চট্টগ্রামে এর নাম হাড়ফাটা, সিলেটবাসী চেনে ডুবি নামে। ময়মনসিংহে বলে কানাইজু। এ ছাড়া লটকা, লটকাউ, কিছুয়ান -এসব নামেও ফলটি পরিচিত। আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম Burmese grap। বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida। গাছ ছোটখাটো ঝাঁকড়া ধরনের। পাতা ডিম্বাকৃতির, গাঢ় সবুজ। বসন্তে ফুল আসা শুরু। ফল পাকতে বর্ষা। ডুমুরের মতো লটকনও গাছের কাণ্ড ও মোটা ডালের বাকল ফেটে লম্বা বৃন্তে গুচ্ছাকারে ধরে। একটি গুচ্ছে কুড়ি থেকে ত্রিশটি পর্যন্ত ফল ধরতে পারে। লটকন বেশ পরিচিত ফল। সে কারণে কম-বেশি সবাই জানে এর মোটা খোসার ভেতরে তিন-চারটি রসাল কোষ থাকে, যেগুলোর স্বাদ অম্লমধুর। কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে জানা গেল, লটকন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। গবেষকেরা বারি-১ নামে লটকনের একটি উন্নতজাত উদ্ভাবন করেছেন।
লটকনের পুষ্টিমান প্রচুর। আসলে আমাদের দেশি মৌসুমি ফলগুলোর প্রতিটিই স্বাদে যেমন বিচিত্র, তেমনি পুষ্টিমানেও অনন্য। লটকনে প্রচুর পরিমাণ রয়েছে ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। রোজ আমাদের দেহের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন, চারটি লটকন সেই চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। লটকনের ভেষজগুণও রয়েছে। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ ও বমনের ভাব দূর করতে কার্যকর। শুকনো পাতার গুঁড়ো সেবনে ডায়রিয়া নিরাময় ও মানসিক চাপ কমে। কাজেই হাতের নাগালে থাকা দেশি ফলের স্বাদ যত বেশি, আস্বাদন করা যায় ততই ভালো।
চাষ পদ্ধতি
মাটি
» শুনিকাশযুক্ত প্রায় সব ধরণের মাটিতেই লটকনের চাষ করা যায়।
» তবে বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী।
» উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি এবং উন্মুক্ত বা আংশিক ছায়া চাষ করা যায়।
চারা রোপণের সময়
» বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস গাছ রোপণের উপযুক্ত সময়
» তবে বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়।
রোপণের দূরত্ব
» সারি থেকে সারির দূরত্ব : ৬ মিটার
» চারা থেকে চারার দূরত্ব : ৬ মিটার
গর্ত তৈরি
» গর্তের আকার হবে ৯০ সেমি
» গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
সার – সারের পরিমাণ/গর্ত
» গোবর / জৈব সার – ১৫-২০ কেজি
» টিএসপি – ৫০০ গ্রাম
» এমপি – ২৫০ গ্রাম
» গর্ত ভর্তি করার সময় মাটি শুকনা হলে গর্তে পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে।
চারা রোপণ ও পরিচর্যা
» সাধারণত বীজ দিয়ে লটকনের বংশ বিস্তার করা যায়।
» সমতল জমিতে বর্গাকার বা আয়তাকার পদ্ধতিতে লটকনের চার লাগানো যেতে পারে।
» গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে নির্বাচিত চারা সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে।
» চারা লাগানোর পর পর পানি দিতে হবে।
» প্রতি ১-২ দিন অন্তর পানি দিতে হবে।
» প্রয়োজনবোধে বাঁমের খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ
প্রতি বছর পূর্ণবয়স্ক গাছে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম – সারের পরিমাণ/গাছ
» গোবর / জৈব সার – ১৫-২০ কেজি
» ইউরিয়া – ১ কেজি
» টিএসপি – ০.৫ কেজি
» এমপি – ০.৫ কেজি
অথবা মিশ্রসার প্রয়োগ করলে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম – সারের পরিমাণ/গাছ
» গোবর / জৈব সার – ১৫-২০ কেজি
» এনপিকেএস মিশ্র সার – (১২-১৫-২০-৬) ১ কেজি
উপরোক্ত সার গাছের গোড়া থেকে ১ মিটার দূরে যতটুকু জায়গায় দুপুুর বেলা ছায়াপড়ে ততটুকু জায়গায় ছিটিয়ে কোঁদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচ
» চারা রোপণের প্রথম দিকে ঘন ঘন সেচ দেয়া দরকার
» ফল ধরার পর দু’একটা সেচ দিতে পারলে উপকার পাওয়া যায়।
ডাল ছাঁটাই
» গাছের মরা, রোগাক্রান্ত ও কীটাক্রান্ত ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে।
ফল সংগহ
শীতের শেষে গাছে ফুল আসে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ফল পাকে।
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।