দাড়িওয়ালা লিচু রাম্বুটান
রাম্বুটান ফলের চেহারা দেখে অনেকেই ওকে দাড়িওয়ালা লিচু বলে থাকেন। কেননা লিচুর মতো ফলটির খোসায় কাঁটার বদলে আছে আঁশের মতো নরম কাঁটা বা চুলের মতো মোটা আঁশ। রাম্বুটান এ দেশের ফল নয়। ফলটির আদি নিবাস পশ্চিম মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা। তবে ফলটি এখন থাইল্যান্ডে প্রচুর ফলছে। চাষ করা হচ্ছে জাভা, বোর্নিও, কম্বোডিয়া, ফিলিপিন, মিয়ানমার, ভিয়েতনামেও। রাম্বুটান এই ফলের ইংরেজি নাম। ফরাসি ভাষায় লিচি চিভাল, স্প্যানিশে রাম্বুতাও, থাইল্যান্ডে নু ফন্সুয়ান। বাংলা কোনো নাম নেই। তবে গাজীপুর, ভালুকা, ময়মনসিংহ, রাঙ্গামাটিতে কয়েকটি গাছে বেশ ভালোই ফল দিচ্ছে। তাই আশা করা যাচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে এ দেশে চাষের উপযোগী রাম্বুটানের কিছু জাত পাওয়া যাবে।
রাম্বুটানের পরিচয় : রাম্বুটানের গাছ মাঝারি আকারের বৃক্ষপ্রকৃতির, লম্বা হয় প্রায় ১০-২৫ মিটার। বেশ ঝোপাল স্বভাবের। গাছের উচ্চতার প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ হলো পত্রপল্লবের বিস্তার বা ক্যানোপি। একটি বোঁটায় দু-চারটি পাতা একত্রে থাকে। ডালে পাতাগুলো বিপরীতমুখীভাবে সাজানো থাকে। পাতার কক্ষ থেকে ফুলের মঞ্জরী বের হয়। ডালের আগা বা পার্শ্বীয়ভাবে পুষ্পমঞ্জরী বের হয়। ফুল খুবই ছোট, ফুলের রঙ সবুজাভ, একটি ছড়ায় ৬০০ থেকে দুই হাজার ফুল ফোটে। কিন্তু থোকায় ফল অত ধরে না। ভালমেয়র (১৯৭০) ফুল ধরার প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে রাম্বুটান গাছকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেনন্ধ
পুরুষগাছন্ধ এ শ্রেণীর রাম্বুটান গাছে শুধু পুরুষ ফুল ফোটে (সাধারণত রাম্বুটানের চারা লাগানোর পর ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ গাছই পুরুষ প্রজাতির হয়ে যায়।)
স্ত্রীপ্রধান উভলিঙ্গীগাছন্ধ এসব রাম্বুটান গাছে পুরুষ ও স্ত্রী দুই রকম ফুলই ফোটে। তবে এসব গাছে সাধারণত স্ত্রী ফুলই সক্রিয় বা কার্যকর থাকে।
পুরুষপ্রধান উভলিঙ্গীগাছন্ধ এসব রাম্বুটান গাছে পুরুষ ও স্ত্রী দুই রকম ফুলই ফোটে। তবে এসব গাছে সাধারণত স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ফুলই সক্রিয় বা কার্যকর থাকে। চাষাবাদের জন্য এ শ্রেণীর রাম্বুটান গাছই উপযুক্ত।
ফল লিচুর মতোই থোকা ধরে। ফল ডিম্বাকার থেকে গোলাকার। কাঁচাফলের রঙ সবুজ, পাকলে লাল হয়ে যায়। খোসা লম্বা খাটো সোজা বাঁকা ইত্যাদি নানা আকৃতির কাঁটাযুক্ত। তবে কাঁটাগুলো শক্ত নয়। খোসা ছাড়ালেই ভেতরে লিচুর মতো সাদা শাঁস পাওয়া যায়। শাঁসের স্বাদ মিষ্টি টক, রসালো। ভেতরে লিচুর মতো একটি বীজ থাকে, বীজ শক্ত, লম্বাটে, ডিম্বাকার ও বাদামি রঙের। ফলের মোট ওজনের ৩০ থেকে ৫৮ শতাংশ থাকে শাঁস, ৪ থেকে ৯ শতাংশ বীজ। প্রতিটি ফলের ওজন ৩০-৬০ গ্রাম। ফল ধরে গ্রীষ্মকালে।
ফলের পুষ্টিমান : রাম্বুটানের প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে আছে ৮৩ গ্রাম পানি, ০.৮ গ্রাম প্রোটিন, ১৪.৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৩ মিলিগ্রাম আয়রন, ২০ থেকে ২৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং সামান্য ফ্যাট।
উপযুক্ত আবহাওয়া : এশীয় দেশগুলোতে ২২ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে রাম্বুটান জন্মে। কিন্তু অব-উষä ও কিছুটা ঠাণ্ডা অঞ্চলে ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ভালো হয়। যেসব এলাকায় বেশি বৃষ্টিপাত হয় সেখানে রাম্বুটান ভালো হয়। তা না হলে বেশি সেচ দিতে হবে। বিশেষ করে ফুল আসার সময় থেকে ফল সংগ্রহের আগ পর্যন্ত সেচ চালিয়ে যেতে হবে। তাপমাত্রা ও বাতাসের জলীয় বাষ্প বা আর্দ্রতা হঠাৎ কমে গেলে অনেক সময় রাম্বুটান গাছের ডগা শুকিয়ে আসে এবং পাতার কিনারা হলদে হতে শুরু করে।
উপযোগী মাটি : উঁচু, যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না এরূপ সুনিষ্কাশিত বেলে দো-আঁশ মাটি রাম্বুটান চাষের জন্য ভালো। তবে এঁটেল-দো-আঁশ মাটিতেও চাষ চলে। তবে মাটিতে বেশি জৈবপদার্থ থাকলে বা দিলে রাম্বুটানের গাছ ভালো বাড়ে ও ফল বেশি ধরে। মাটির অম্লমান বা পিএইচ মান ৪.৫ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে হওয়া ভালো।
জাত : বিশ্বে রাম্বুটানের অনেক জাত আছে। তবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন ও থাইল্যান্ডে যেসব জাত জন্মে ও ভালো ফল দেয় সেগুলোই এ দেশের জন্য নির্বাচন করে চাষ করা যেতে পারে। কেননা ওই সব দেশের আবহাওয়ার সাথে এ দেশের আবহাওয়ার কিছুটা মিল রয়েছে। রাম্বুটানের সবচেয়ে বেশি জাত দেখা যায় মালয়েশিয়ায়। সে দেশে রাম্বুটানের ১৫টি জাত রয়েছে। বিভিন্ন দেশে রাম্বুটানের অনেক জনপ্রিয় জাত রয়েছে।
তবে বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য ফিলিপাইনের সিবাবাত, সিঙ্গাপুরের লি, মালয়েশিয়ার পি১, পি৪, পি৫, পি৬, পি৮, পি২২, পি২৮, পি৫৪, পি৬৩ এবং ইন্দোনেশিয়ার মেরাহ ও কোয়েনেং জাতগুলো উল্লেখযোগ্য।
চারা তৈরি : জোড়কলম করে রাম্বুটানের চারা তৈরি করা হয়। বীজ থেকে গজানো এক বছর বয়সী চারার মাথা কেটে, সেখানে ফাটল করে ফল ধরা কোনো রাম্বুটান গাছের ডগা তেরছা করে কেটে গোজের মতো ঢুকিয়ে ফিতে দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিকে বলে ক্লেফট গ্রাফটিং। তেজি কোনো ভিত্তি চারার ওপর ফোরকাট বা চোখকলম করেও রাম্বুটানের কলম করা হয়। লিচুর মতো বায়ব দাবা কলম করেও প্রতিষ্ঠিত কোনো ফলবান গাছের ডাল থেকে রাম্বুটানের চারা তৈরি করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে সফলতা কম পাওয়া যায়। চোখকলম করেও সুঠাম আকৃতির ভালো গাছ পাওয়া যায়। বসন্তকাল আসার ঠিক আগে চোখকলম করার উপযুক্ত সময়।
চাষপদ্ধতি : প্রচণ্ড শীতের সময় ছাড়া বছরের যেকোনো সময় রাম্বুটানের চারা লাগানো যায়। তবে বর্ষার আগে লাগানো উত্তম। সব দিকে ৮০ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার মাপে গর্ত করে গর্তের মাটিতে আধাআধি পরিমাণ জৈবসার ও মাটি মিশিয়ে সপ্তাহখানেক রেখে দিতে হবে। তারপর গর্তের মাঝখানে খাড়া করে চারা লাগিয়ে কাঠির সাথে বেঁধে গোড়ায় সেচ দিতে হবে। বাণিজ্যিক বাগান করলে হেক্টরপ্রতি ৮০ থেকে ১২০টি চারা লাগানো যায়। গাছের কাণ্ড থেকে সব অবাঞ্ছিত ডগা ও মরা ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। প্রতিবার ফল তোলার পর ফল ধরা ডালগুলোর আগা লিচুগাছের মতো ভেঙে দিতে হবে। এতে নতুন করে অনেক ডালপালা গজাবে ও বেশি ফুল-ফল ধরবে। খরা চলতে থাকলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে। বিশেষ করে ফুল আসার সময় মাটি শুকাতে দেয়া যাবে না। এতে ফুল শুকিয়ে যাবে বা ঝরে যাবে। একটা-দুটো গাছ লাগালে গাছের গোড়ার কিছুটা দূর দিয়ে ঘুরিয়ে মাটি উঁচু করে আইল বেঁধে থালার মতো করে থালার মধ্যে ভাসিয়ে সেচ দেয়া যায়। বাণিজ্যিক বাগানের জমি ভাসিয়ে সেচ দিতে হবে। গাছের বৃদ্ধি বুঝে ও বয়স ধরে ১৪:৪:৩.৫ অনুপাতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ ঘটিত সার প্রয়োগ করতে হবে। অল্প করে ডলোমাইট চুন দেয়া যেতে পারে, তবে বেশি দিলে ক্ষতি হবে। এমনকি ডলোমাইটের সাথে যদি চুন এক সাথে দেয়া হয় তাতেও গাছের ক্ষতি হবে, বিশেষ করে তরুণ গাছের। গাছের বয়স ২০ বছর না হওয়া পর্যন্ত রোপণের পর থেকেই সার প্রয়োগ চালিয়ে যেতে হবে।
সাধারণত বসন্তের পরপরই শুষ্ক দিনে রাম্বুটানের ফুল আসে এবং গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফল পাকে। ফুল ফোটার পর ফল পাকতে প্রায় ৯০ থেকে ১২০ দিন লাগে। চারা লাগানোর তিন বছর পর থেকেই ফল ধরতে শুরু করে এবং ২০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন পাওয়া যায়। জাত অনুযায়ী তিন বছরের একটা গাছে ১৫ থেকে ২০ কেজি ফল পাওয়া যায়, নয় বছরের একটা গাছে ৫৫ থেকে ২০০ কেজি ফল পাওয়া যায়, ২০ বছরের একটা গাছে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি ফল পাওয়া যায়। ফল পাকলে লালচে রঙ চলে আসে। তখন একটা একটা করে বা গোটা থোকাসহ ফল তোলা যায়।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।