থাই আম চাষের পদ্ধতি
থাইল্যান্ডে চাষ করা আমের জাত এ দেশে থাই আম নামে পরিচিত। তবে কোনো থাই আমের জন্ম থাইল্যান্ডে নয়। আমের আদি নিবাস এই ভারতীয় উপমহাদেশেই। থাইল্যান্ড আমের কিছু আদি জাত নিয়ে গবেষণা করে উন্নত অনেক জাত উদ্ভাবন করেছে। সেসব জাতের মধ্যে বেশ কিছু জাত তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করছে। কিছু কিছু জাত অন্য দেশের মাটিতেও চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ড থেকে বেশ কিছু জাতের আম এ দেশে এসেছে। জাতগুলো হলো চুকানন, মিয়াচাও, মোহাচনক, নাম ডক মাই, নাম ডক মাই মান, নাম ডক মাই ৪, উমরন, থাই কাঁচামিঠা প্রভৃতি। এসব জাতের মধ্যে এ দেশে নাম ডক মাই জাতটি পাকা আম হিসেবে এবং থাই কাঁচামিঠা জাতটি কাঁচা আম হিসেবে খাওয়ার জন্য অনেকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। নাম ডক মাই জাতটি এ দেশে বিভিন্ন নার্সারিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিতি পেলেও জাতটি আসলে একই। বৃক্ষমেলাসহ বিভিন্ন নার্সারিতে এখন নাম ডক মাই জাতের আমের চারা পাওয়া যাচ্ছে।
নাম ডক মাই জাতের বৈশিষ্ট্য : এ জাতের আম কাঁচা ও পাকা দুই অবস্খাতেই খাওয়া যায়। গাছ মাঝারি আকৃতির, ঘন পত্রপল্লববিশিষ্ট, গাছের গড়ন খাড়া। নতুন পাতা হালকা সবুজ রঙের, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাঢ় সবুজ হয়ে যায়। ছয় বছরের একটা গাছ ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কলমের চারা লাগানোর পরের বছর থেকেই গাছে মুকুল আসে ও ফল ধরে। চারার গাছে ফল ধরতে চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যায়।
এ জাতের ফল লম্বাটে, একটু বাঁকানো, অগ্রভাগ ক্রমেই সরু ও ভোঁতা। কাঁচা আমের রঙ সবুজ, কিন্তু পাকার পর খোসা পুরোপুরি হলুদ হয়ে যায়। একটি আমের গড় ওজন ৩০০ গ্রাম, সাধারণত ২৫০ থেকে ৪০০ গ্রামের মধ্যে আমের ওজন হয়ে থাকে। এ জাতের আম প্রায় ১৩ সেন্টিমিটার লম্বা ও ছয় সেন্টিমিটার চওড়া। পাকার পর শাঁসের রঙ হয় হলুদ ও নরম। শাঁস খুবই মিষ্টি ও আঁশবিহীন। তবে খোসার কাছে শাঁস নরম হতে হতে আঁটির কাছের শাঁস অনেক সময় বেশি নরম হয়ে জেলি বা কাদার মতো হয়ে যায়। আমের ওজনের চার ভাগের তিন ভাগই শাঁস, এক ভাগ খোসা ও আঁটি। খোসা বেশ পাতলা। পাকার পর আম থেকে মৃদু মিষ্টি ঘ্রাণ বের হয়। এ জাতের আমের বীজ বহুভ্রূণী বা পলিঅ্যামব্রায়নি প্রকৃতির। সচরাচর একটা আমের আঁটি থেকে একটা চারাই হয়। কিন্তু এ জাতের আমের একটি আঁটি থেকে অনেকগুলো চারা হয়। প্রায় সব জাতের আমেরই আঁটি থেকে গজানো চারায় মাতৃগুণ হুবহু এক না থাকলেও নাম ডক মাই জাতের আঁটি থেকে গজানো চারায় মাতৃগুণ একই থাকে এবং সে চারার গাছে ধরা আমগুলোর বৈশিষ্ট্যও হয় একই।
চাষাবাদ : বাড়ির আঙিনায়, ছাদে ড্রামে, পুকুরপাড়ে, বাণিজ্যিক বাগানে নাম ডক মাই জাতের আমগাছ লাগানো যায়। বসতবাড়িতে শখ করে দু-একটা গাছ লাগানো যেতে পারে। তবে কেউ যদি দু-এক হেক্টর জমিতেও এ জাতের বাণিজ্যিক বাগান গড়তে চান তো সে ক্ষেত্রে আম্রপালি আমের চেয়ে লাভ কম হবে না। এ জাতের আমের গাছ লাগানোর জন্য চাই উঁচু জমি, যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির পানি আটকে থাকে না। বেলে, বেলে দোআঁশ ও উপকূলের লোনা মাটি ছাড়া যেকোনো মাটিতে নাম ডক মাই জাতের আম চাষ করা যেতে পারে। চাষ করা যায় লাল মাটি ও পাহাড়েও। তবে দো-আঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। এরূপ মাটিতে জৈবসার ব্যবহার করে চাষ করলে গাছের বাড়বাড়তি ও ফলন ভালো হয়।
কলমের গাছ লাগালে অতি ঘন পদ্ধতিতে দূরত্ব কম দিয়ে চারা লাগানো যায়। পরে পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সেসব গাছ থেকে ফল পাওয়ার পর দুই গাছের মাঝখান থেকে একটা গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলা যায়। এতে প্রথম তিন থেকে চার বছরে একই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় দ্বিগুণ লাভ হতে পারে। কাটার পর বাকি গাছগুলো স্খায়ীভাবে রেখে ভালো করে যত্ন নিলে সেসব গাছ পূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত এ জাতের চারা বা কলম লাগানোর জন্য চার থেকে ছয় মিটার দূরত্ব দেয়া হয়। এ দূরত্বের হিসাবে হেক্টরপ্রতি ১৮৫ থেকে ২৭৮টি চারা লাগানো যায়। অতি ঘন পদ্ধতিতে তিন মিটার দূরত্ব দিয়ে সব দিকে সারি করে গাছ লাগানো যেতে পারে। তা না হলে প্রথমেই ছয় মিটার দূরে দূরে চারা বা কলম লাগিয়ে মাঝখানের জায়গা ফাঁকা না রেখে গাছ যথেষ্ট বড় না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন শাকসবজি, মুগ ও মাষকলাই ডাল, তিল, আদা প্রভৃতি লাগানো যায়। লাগানোর সাত থেকে ১০ দিন আগে গর্ত খুঁড়ে গর্তের মাটিতে গর্তপ্রতি ১০ থেকে ১৫ কেজি গোবর সার মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। কলম বা চারা সুরক্ষার ব্যবস্খাও করতে হবে। বর্ষাকাল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে পলিব্যাগ বা টবের কলম খুব শীত ছাড়া বছরের যেকোনো সময় লাগানো যায়। সে ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্খা করতে হবে। গর্তের ঠিক মাঝখানে চারাটি সোজা করে লাগিয়ে চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে। চারা বাড়তে শুরু করলে গাছের গোড়ার চার পাশে চারটি ট্যাবলেট সার পুঁতে দিলে সারা বছর আর কোনো সার দেয়ার দরকার পড়ে না। তবে দ্বিতীয় বছর থেকে পরিমাণমতো ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিঙ্ক ও জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে বোরন সারও দিতে হবে। না হলে আমের গুটি ফেটে যেতে পারে। এ জাতের আমগাছের সুন্দর গড়ন, বাড়বাড়তি, রোগ-পোকার আক্রমণ কমানো ও ভালো ফলনের জন্য ছাঁটাই খুব দরকার। বিশেষ করে রোপণের পর প্রথম কয়েক বছর ছাঁটাই কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতে মূল কাণ্ড বা গুঁড়ি মজবুত হওয়া ছাড়াও গাছের মাথা বেশি ঝাঁকড়া হয়, বেশি ফুল-ফল ধরে। গাছে ফল ধরা শুরু হলে নিচে ঝুলে পড়া ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। খুব ঘনভাবে এঁটে থাকা ডালও ছেঁটে পাতলা করে দিতে হবে। গাছকে ছেঁটে তিন থেকে পাঁচ মিটার উচ্চতার মধ্যে রাখতে পারলে স্প্রে করা ও ফল তুলতে সুবিধে হয়। এ জাতের গাছে নিয়মিতভাবে প্রতি বছরই ফল ধরে, তবে সব বছর সমান ধরে না।
চারা বা কলম তৈরি : সরাসরি বীজ বা আঁটি থেকে চারা তৈরি করা যায়। পূর্ণভাবে পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে আরো দু-চার দিন ঘরে রেখে নরম করতে হবে। এরপর আম থেকে আঁটি সংগ্রহ করে প্রথম বীজতলার মাটিতে বসাতে হবে। বীজতলায় ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে আঁটিগুলো সারি করে বসানোর পর আঁটির ওপরে আলগা ঝুরা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আঁটি বের করার পরপরই বীজতলার মাটিতে ফেলতে পারলে ভালো, না হলে অল্প কিছু দিনের জন্য ছায়ায় শুকিয়ে চটের বস্তায় ভরে রেখে দেয়া যায়। একটা আঁটি থেকে যে কয়টি চারা গজাবে সে চারাগুলোকে শেকড়সহ সাবধানে কেটে আলাদা করে দ্বিতীয় বীজতলায়, টবে বা বড় পলিব্যাগে গোবর মিশানো মাটিতে বসাতে হবে। এক বছর বয়স হলে সেসব চারা বাগানে লাগানোর উপযুক্ত হবে। জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত চারা তৈরির উপযুক্ত সময়।
তবে কলম করতে চাইলে মাঝারি আকারের গাছ হয় এমন কোনো দেশী জাতের আমের আঁটি থেকে প্রথমে চারা তৈরি করে নিতে হবে। চারার মাথা কেটে ফাটল তৈরি করে ক্লেফট গ্রাফটিং পদ্ধতিতে নাম ডক মাই গাছের ডগা তেরছা করে কেটে ফাটলে ঢুকিয়ে ফিতে দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ক’দিনের মধ্যে জোড়া লেগে যায়। জুড়ে দেয়া ডগা থেকে নতুন পাতা ছাড়া শুরু হলেই বুঝতে হবে জোড়া লেগে গেছে। নতুন চারা উৎপাদনের জন্য এ পদ্ধতিই ভালো। কেননা এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত কলমের গাছে রোপণের এক থেকে দুই বছর পর থেকেই ফল ধরতে শুরু করে।
বালাইব্যবস্খাপনা : এ জাতের গাছে পাউডারি মিলডিউ বা সাদা গুঁড়া রোগ বেশি হয়। ছত্রাকজনিত এ রোগটি মুকুল ও মুকুলের ডাঁটিতে আক্রমণ করে সাদা পাউডারে ঢেকে ফেলে। এতে ফুল ও ছোট ফল পচে নষ্ট হয়, সব ঝরে পড়ে। মুকুল আসার পর থেকে ফল কলাইদানার মতো হওয়া পর্যন্ত এ রোগটি সাধারণত আক্রমণ করে। কুয়াশা হলে রোগটা বাড়ে। রোগের আক্রমণে দানা বেঁধে ওঠা গুটিও ঝরে যায়। তাই মুকুল আসার পরপরই ফুল ফোটার আগেই যেকোনো অনুমোদিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া কাঁচা অবস্খায় আমের মুখ ছিদ্র করে একধরনের পোকা ভেতরে ঢুকে শাঁস ও কচি আঁটি খেয়ে নষ্ট করে দেয়। পাকার সময় আক্রমণ করে ফলের মাছি। ওরাও ফল ছিদ্র করে শাঁস খেয়ে পাকা আম নষ্ট করে। তাই এসব পোকার আক্রমণ থেকে ফল রক্ষার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।