আমির হোসেন উদ্ভাবিত ধান কাটার যন্ত্র

আমির হোসেন উদ্ভাবিত ধান কাটার যন্ত্র

ক্ষেতভরা সোনালি ধান দেখে আনন্দে মন নাচে কৃষকের। একই সঙ্গে একটু দুরুদুরু ভাবও থাকে। ধান পাকার মৌসুমে যখন-তখন ঝড়বৃষ্টি বা শিলায় ফসল নষ্ট হয়। এ জন্য ভালোয় ভালোয় ধান কেটে ঘরে তুলতে হন্যে হয়ে ওঠেন কৃষকেরা। কিন্তু ধান কাটা মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। বোরো বা আমন মৌসুমে সব ক্ষেতের ধান পাকতে শুরু করে। এতে এলাকার মজুরেরা একসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের কাছে ধরনা দেওয়া এক ঝক্কি। কাজটি যদি সুবিধাজনক এক যন্ত্রের ওপর চাপানো যায়, তাহলে ধান কাটা নিয়ে আর দুর্ভাবনা নেই। এ চিন্তা মাথায় রেখে বগুড়া শহরের আমির হোসেন ধান কাটার এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন, যা টেকসই ও হালকা; আর দামেও কম। এটি কৃষকদের শুধু মজুরসংকট থেকেই বাঁচাবে না, আনুষঙ্গিক ব্যয়ও কমাবে।

উদ্ভাবকের এগিয়ে আসা: বগুড়া শহরের কাটনার পাড়ার বাসিন্দা আমির হোসেন (৫০)। সেখানে রয়েছে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। ছোটখাটো বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় সেখানে। আমির হোসেন নিজেই তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগর। এই কারিগরি গুণ বাবার কাছ থেকে পাওয়া।

আমির হোসেন জানান, ১৯৪০ সালে তাঁর বাবা ধলু মেকার এই কারিগরি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি একটি সাইরেন যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাস করে আমির বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে বাবা মারা গেলে আমির ব্যবসা পরিচালনার ভার নেন।

শুরু থেকেই আমির উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে আসছেন। তাত্ত্বিক কোনো কারিগরি জ্ঞান তাঁর নেই। নেই প্রযুক্তিবিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ। স্রেফ হাতে-কলমের অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনী মেধা কাজে লাগিয়ে তিনি একের পর এক বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে যাচ্ছেন। প্রথমে তিনি চিকন সেমাই উত্পাদনের একটি যন্ত্র তৈরি করেন। স্বল্প পুঁজির অনেক ব্যবসায়ী এ যন্ত্র ব্যবহার করে উপকার পাচ্ছেন। তাঁর উদ্ভাবিত ‘বগুড়ার চিকন সেমাই মেশিন’ এখন সারা দেশে প্রচলিত। তাঁর তৈরি ইটভাঙা ও ইট তৈরির যন্ত্রও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার তিনি কৃষকদের কষ্ট লাঘবে উদ্ভাবন করেছেন ধান কাটার যন্ত্র, যার নাম দিয়েছেন ‘কলের কাঁচি’।

আমির বলেন, ‘মূলত ধান কাটার জন্য এই যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি দিয়ে গম, ভুট্টা, পাট, আখসহ অন্যান্য শস্যও কাটা যাবে।’

তৈরি হলো যেভাবে: কোনো যন্ত্র একবার মনে ধরলে অবিকল সে-রকম যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করেন আমির হোসেন। এটি তাঁর শখ। বছরখানেক আগে তিনি গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়ে ধান কাটার একটি যন্ত্র দেখেন। যন্ত্রটি বেশ বড়। আমির জানতে পারেন, বিদেশ থেকে এটি প্রায় ১২ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। যন্ত্রটি তাঁর মনে ধরে। স্বল্পমূল্যে চাষিদের এমন একটি যন্ত্র উপহার দেওয়ার কথা ভাবেন তিনি।

বাড়ি ফিরে আমির তাঁর মেয়ে আশার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। আশা বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজের শিক্ষার্থী। যন্ত্রের নকশা তৈরির ওপর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ রয়েছে তাঁর। বাবার কথামতো ধান কাটার যন্ত্রের একটি নকশা তৈরি করেন তিনি। আমির নকশামতো যন্ত্র তৈরিতে নেমে পড়েন। প্রায় এক বছর ধরে এই মেধা ও শ্রম দিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘কলের কাঁচি’।
এই কলের কাস্তে তৈরিতে আমির দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে পাইপ, কার্বন স্টিল পেনিয়াম, কার্বন স্টিল ব্লেড রয়েছে। যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া হয়েছে দেড় অশ্বশক্তির পেট্রলচালিত ইঞ্জিন।

আমির জানান, তাঁর ‘কলের কাঁচি’ দিয়ে দুই ঘণ্টায় এক একর জমির ধান কাটা যাবে। প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে খরচ হবে ৬০—৭০ টাকা। যন্ত্রটি তুলনামূলকভাবে হালকা হওয়ায় এটি দিয়ে পূর্ণবয়স্ক যে কেউ সহজে ক্ষেতের ফসল কাটতে পারবেন। তিনি জানান, কৃষকেরা এখন যন্ত্রটি আট হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় কিনতে পারবেন। যন্ত্রটি আরও সস্তা ও আধুনিক করতে তিনি কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে কৃষক পাঁচ-ছয় হাজার টাকায় এটি কিনতে পারবেন।

সরেজমিনে একদিন: সম্প্রতি বগুড়া সদর উপজেলার জয়পুরপাড়া গ্রামে এই যন্ত্র দিয়ে আমিরকে ধান কাটতে দেখা যায়। শত শত গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে তিনি তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে সফলভাবে ৩০ শতক জমির ধান কেটে দেখান। এ সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক রোস্তম আলী মণ্ডল ও কৃষি বিভাগের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

জমির আইল দিয়ে ছোট একটি যন্ত্র নিয়ে আমির হোসেন যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন উপস্থিত নারী-পুরুষেরা বলাবলি করছিলেন, ‘এই যন্ত্র দিয়ে কেংকা করে ধান কাটপি?’
পরে আমিরের সাফল্যে সবাই অভিভূত হন। জয়পুরপাড়ার বৃদ্ধ কৃষক হাছেন আলী বলেন, ‘জিংকা করে এই যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা দেকালো, তাতে হামাগোরে ধান কাটতে বেশি ট্যাকা লাগবি না। কী সুন্দরভাবে ধান কাটিচ্ছে, আর সেগুলো ধীরে ধীরে পড়ে যাওচে। ইংকা জিনিস কেনা লাগবি।’

রোস্তম আলী মণ্ডল বলেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রটি কৃষকের খুব উপকারে আসবে। এটির দাম কম, যা কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। যন্ত্রের কিছুটা আধুনিকায়নের পর বাজারজাত করা হলে চাষিরা উপকৃত হবেন।

বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর যুগ্ম পরিচালক (প্রকৌশল বিভাগ) মাহমুদ হোসেন খান বলেন, ‘আমির হোসেন একটি ভালো জিনিস তৈরি করেছেন। যন্ত্রটি দিয়ে ধান কেটে ভালো ফল পেয়েছি। সরকারি সহযোগিতায় এই যন্ত্র সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হলে ধান কাটার সময় যে শ্রমিকসংকট দেখা দেয়, তা থাকবে না।
এগ্রোবাংলা ডটকম