ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি
নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য ফল উৎপাদনের কৌশল হিসেবে উৎপাদনের শুরু থেকেই একটি নিরাপদ কৌশল গ্রহন করা হয়। আজ আমরা জানবো সেই কৌশল সম্পর্কে।
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি কি?
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা বয়সে বিশেষ ধরণের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায়। ব্যাগিং করার পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকে ব্যাগটি। এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রঙ এবং আকারের হয়ে থাকে। তবে আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙের এবং সবুজ আমের জন্য দুই আস্তরের বাদামি ব্যাগ।
কোন কোন ফলে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়
আম, পেয়ারা, ডালিম, কলা, কাঁঠালে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। বর্তমানে বেগুনেও ফ্রুট ব্যাগিং করা হচ্ছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফসল নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগী।
ফ্রুট ব্যাগিং কেন প্রয়োজন?
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ফলে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্রেকজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্প্রে করার প্রকৃত কারণ ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার কারণে ফলচাষিরা এক মৌসুমে ফল বাগানে বহুবার স্প্রে করে থাকেন, যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। যদি আমের কথায় ধরা যায়, আমচাষিরা আম সংগ্রহ করার পর থেকে পরের মৌসুমে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত ১৫-৬২ বার বালাইনাশকের ব্যবহার করে থাকেন। যেখানে গবেষণার ফল থেকে দেখা গেছে ২-৫ বার ক্ষেত্র বিশেষে স্প্রে করলেই ভালো আম সংগ্রহ করা সম্ভব। মাত্রাতিরিক্ত স্প্রে যেমন জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি আমের উৎপাদনকেও ব্যয়বহুল করে তোলে। শুধু তাই নয় অতিরিক্ত স্প্রে করার ফলে উপকারী ও বন্ধু পোকার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বালাইনাশকের ব্যবহার অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। পাওয়া যাবে বিষমুক্ত ফল, কমবে ফলের উৎপাদন খরচ, কমবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা এবং বাড়বে ফলের গুণগতমান। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাগিং করা আম দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। আমকে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন হবে না ফরমালিন নামক বিষাক্ত রাসায়নিকের। এছাড়াও ফলকে বাইরের বিভিন্ন ধরনের আঘাত, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক ও রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে সহজেই রক্ষা করা সম্ভব। যেমন আমের ফল ছিদ্রকারী ও মাছি পোকা আমের বর্ধনশীল পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। যদি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করা হয় তাহলে কোনো স্প্রে ছাড়াই এ ক্ষতিকর পোকা দুইটির হাত থেকে আম ফলকে রক্ষা করা সম্ভব। পেয়ারার ক্ষেত্রেও তাই।
ব্যাগিং প্রযুক্তির প্রধান সুবিধাগুলো হলো
» নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য ফল উৎপাদনের একমাত্র উপায়
» শতভাগ রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণমুক্ত ফল পাওয়া সম্ভব এবং আমের ক্ষেত্রে যে কোন জাতের আমকে রঙিন (হলুদ) করা যায় ফলে বাজারমূল্য বেড়ে যায়
» আমসহ অন্যান্য ফলের সংরক্ষণকাল বাড়ানো যায় (১০-১৪ দিন পর্যন্ত), যেটি রপ্তানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য
কোন ফলে ফ্রুট ব্যাগিং কখন করা প্রয়োজন
গবেষণা করে দেখা গেছে, প্রত্যেক ফলের জন্য ব্যাগিং করার সময় ভিন্ন ধরনের। যেমন আমের ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৩৫-৪০ দিন বয়সের আমে। এ সময়ে আম জাতভেদে মটরদানা থেকে মার্বেল আকারের অথবা এর চেয়ে বড় আকারেরও হয়ে থাকে। পেয়ারার ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৫০-৫৫ দিন বয়সে এবং ডালিমের ক্ষেত্রে ২০-২৫ দিন বয়সে। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়। আমের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি স্প্রে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। যেমন প্রথমবার আম গাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে, দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি. লম্বা হবে তখন এবং আম যখন মটরদানার মতো হবে তখন তৃতীয়বার। সুতরাং এর পরপরই ব্যাগিং করার পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যাগিং করার আগেই মরা মুকুল বা পুষ্পমঞ্জরির অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র অথবা এমন কিছু যা ফলের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে। রঙিন আমের জন্য একস্তর বিশিষ্ট সাদা ব্যাগ এবং যে কোন আমের জন্য দুইস্তর বিশিষ্ট বাদামি রঙ এর ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে দুইস্তর যুক্ত বাদামি রঙ এর ব্যাগ যে কোন আমকে রঙিন অর্থাৎ হলুদ করতে পারে।
কলার ক্ষেত্রে কলার ছড়ি বের হওয়া শুরু হলেই একটি ছত্রাকনাশক দিয়ে স্প্রে করে ব্যাগিং করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিচের প্রান্ত খোলা রাখতে হবে। তবে কলার ছড়ি বের হওয়া সমাপ্ত হলেও ব্যাগিং করা যাবে। সেক্ষেত্রে নিচের প্রান্তও বেঁধে দিতে হবে। কলার ব্যাগগুলো পরিবেশবান্ধব কাগজ দিয়ে তৈরি এবং এটা ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। এই পদ্ধতিতে কলায় কোনো ধরনের দাগ পড়ে না এবং কলার মানও উন্নত থাকে। এই পদ্ধতিতে কলায় রোগ ও পোকার আক্রমণও কম হয়। এতে করে বাজারের অন্যান্য কলার তুলনায় ব্যাগিং পদ্ধতির কলার দামও বেশি পাবেন কলা চাষিরা।
বেগুনের ক্ষেত্রে একটি বেগুনের বয়স দুই থেকে তিন দিন হলেই ব্যাগটি পরানো উচিত। বেগুনের বয়স যত বেশি হবে পোকায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। বিভিন্নজাতে ভিন্ন মেয়াদে (৮/১২ দিন) ব্যাগের মধ্যে বেগুনকে থাকতে হয়। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে এক কেজি বেগুন উৎপাদনে খরচ হবে ১.৫০-২.৫০ টাকা যা ব্যবহৃত বালাইনাশকের খরচের চেয়ে কম এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও বিষমুক্ত বেগুন উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
ব্যবহার শেষে ব্যাগ কি করতে হবে?
ব্যাগের ব্যবহার শেষ হলে সেটি পুড়িয়ে ফেলুন অথবা পানিতে ডুবিয়ে রেখে নষ্ট করুন। পরিবেশকে পরিছন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর এই দায়িত্ব পালনে আমাদেরকেই সহযোগিতা করতে হবে। ফল বিজ্ঞানিরা আশা করেন, দেশের প্রত্যেকটি চাষী ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদন করবেন এবং দেশের সকল মানুষ নির্বিঘ্নে উপভোগ করবেন দেশী রসালো মৌসুমি ফল।
ফ্রুট ব্যাগ কিনতে এখানে ক্লিক করুন
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।