মৎস্য পোনা, খাদ্য ও পুকুর ব্যবস্থাপনা
নদী মাতৃক এ দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ধান ও মাছের প্রাচুর্যতা ছিল বলেই এক সময় আমাদের মাছে ভাতে বাঙালি বল হত। বিভিন্ন সময়ে ধানের উচ্চফলনশীল জাতের অবিষ্কার হলেও মাছের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। বিগত আশির দশকে প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমগুলো বিভিন্ন কারণে সংকুচিত হয়ে আসে। পাশাপাশি কারেন্টজালের ব্যবহার এক ভয়বহ চিত্র তুলে ধরে আমাদের সামনে। এই জাল ব্যবহারের ফলে পানি থাকবে, মাছের অভয়াশ্রম থাকবে, পানির স্রোত থাকবে, খাল, বিল, নদীনালা, হাওড় বাওড় সবই থাকবে, থাকবে না শুধু মাছ। কারণ একটাই, কারেন্ট জাল। তাই আশির দশকে নানাবিধ কারণে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মৎস্যসম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় ৮০০-এর মত মৎস্য হ্যাচারি গড়ে ওঠে।
পোনা সংগ্রহ : আশির দশকে বিভিন্ন হ্যাচারি কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রেনু, রেনু থেকে পোনা আর পোনা থেকে বড় মাছের চাষের উপর সবাই জোর দিতে শুরু করে। ফলে নব্বই-এর দশকে মৎস্যশিল্পে ঘটে বিপ্লব। বর্তমানে এ শিল্প বিভিন্ন কারণে লোকসানের ভার বইতে বইতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে বিন্দু বিন্দু করে গড়া হ্যাচারি মালিকের চোখে আজ গাঢ় অন্ধকার। বেঁচে থাকার জন্য এ সময় আন্ত-প্রজননমুক্ত ব্রুড মাছের পোনা উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে। জোর দেয়া হচ্ছে হালদা, পদ্মা, যমুনার উৎস হতে পোনা সংগ্রহের মাধ্যমে ব্রুড তৈরি করাসহ আরও অনেক নীতিনির্ধারণী কথা। সরকারি আইনের কথাও বলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই- আমাদের দেশে ছোট ছোট হ্যাচারি মালিকদের পক্ষে হালদা বা পদ্মা থেকে পোনা বা ব্রুড সংগ্রহ করা অসম্ভব ব্যাপার।
সরকারি উদ্যোগে এসব পোনা সংগ্রহ করে হ্যাচারি মালিকদের সরবরাহ করার পাশাপাশি উন্নতমানের পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোকে রেজিষ্ট্রিশনের আওতায় আনতে হবে। শুধু উন্নত ব্রুড সরবরাহ করলেই চলবে না, তা বাজারজাত করার জন্য সরকারের রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিদেশ থেকে এখন কার্পজাতীয় মাছ আমাদের দেশে আসে। আর এই কার্পজাতীয় মাছ থেকে উৎপাদিত হয় কোটি কোটি পোনা। কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে- সরকার শুধু পাঙ্গাসের পোনা বা ব্রুড আনার পরিকল্পনা করছে বিদেশ থেকে, কিন্তু কার্পজাতীয় মাছের ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান- হয়নি। এক্ষেত্রে পাঙ্গাসের পোনা আমদানি করলে ৪/৫ বছর লাগবে প্রজননক্ষম হতে, আবার ডিমঅলা মাছ অনাও সম্ভব নয়। এটুকু বুঝতে বুঝতে অনেকটা সময় আমাদের পার হয়ে গেছে। তাই, বিদেশ থেকে মাছ আমদানিতে দেরি করা এখন আর ঠিক হবে না।
মৎস্য খাদ্য : মৎস্য খাদ্য উৎপাদনের মূল উপকরণের মধ্যে রয়েছে খৈল, কুঁড়া, শুটকি মাছের গুঁড়া, মিট এন্ড বোন উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে স্থানীয়ভাবে যোগান দেয়া হয় খৈল, কুঁড়া এবং অল্প পরিমাণে শুটকি গুঁড়া। বিদেশে শুটকির উচ্চমূল্য থাকার কারণে
কম মূল্যে মিট এন্ড বোন দিয়ে মৎস্য খাদ্য প্রস্তুত হয়। খাদ্য পরীক্ষা করলে হয়ত কাঙ্ক্ষিত প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে কিন্তু মিট এন্ড বোন দিয়ে তৈরি খাদ্য মাছ কতটুকু হজম করতে পারে বা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা সে পরীক্ষার দাবি রাখে। মৎস্য খাদ্য প্রস্তুতে এসব উপাদান মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকারক কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
আমাদের দেশে রাইসমিলে উন্নতমানের কুঁড়া পাওয়া যায়। পোল্ট্রি ও মৎস্যশিল্পে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। দুঃখের বিষয় যে, এই কুঁড়া দেশের চাহিদা না মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে। আর সেই কুঁড়া থেকে তেল তৈরি হয়ে ফিরে আসে আমাদেরই দেশে। আমরা কিন্তু সেই কুঁড়াই আবার বিদেশ থেকে কিনে আনছি আমাদের প্রয়োজন মেটাতে বেশি দামে। এদিকে সরকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
পুকুর ব্যবস্থাপনা: পুকুরের ভাল পরিবেশ বলতে বোঝায়- প্রতিবছর একবার করে পুকুরের তলা শুকিয়ে অথবা তলার মাটি ফেলে দিয়ে পুকুরকে সারা বছরের জন্য গ্যাসমুক্ত রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা ও সারা বছরই মাছ যাতে রোগমুক্ত থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক খামারি মাছ চাষে কোন সমস্যা হলেই চুন ব্যবহার করেন বা অন্যকে করতে পরামর্শ দেন। এটা ঠিক না। পুকুরের পানিতে পি.এই -এর মাত্রা বেশি থাকার পরও চুন প্রয়োগ করলে পি.এইচ -এর মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ফলে মাছ চাষে ক্ষতির সন্মুখিন হতে হয়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কত থাকা দরকার, কত মাত্রা পর্যন- অ্যামোনিয়া মাছ চাষে সহায়ক তা শতকরা ৯৮ ভাগ মৎস্য খামারিরা জানে না। অপরীক্ষিত নানা ওষুধ দিয়ে খামারিরা মাঝে মাঝে ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখিন হয়। তাই মৎস্য বিভাগকে নিতে হবে এইসব মৎস্য খামারিদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব। সমাধান করতে হবে তাদের নানা ধরনের সমস্যা।
লেখক: এ. কে. এম. নূরুল হক, স্বত্বাধীকারী-ব্রহ্মপুত্র ফিস সীড কমপ্লেক্স (হ্যাচারি) শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।