পেঁয়াজ চাষ

পেঁয়াজ চাষ

পেঁয়াজ চাষ ও করণীয়

বাঙালির ভোজন বিলাসিতার পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। আর ভোজন বিলাসিতায় নানাবিধ মসলার সমন্বয়ে রন্ধনশৈলীর উপস্থাপনা যে কোনো মানুষের মন জয় করে নিতে এতটুকু সময় লাগে না। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এশিয়ান লোকেরা যে হারে মসলার ব্যবহার করে থাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে তা লক্ষণীয় নয়। আর খাবারকে রুচিশীল ও মুখরুচক করতে মসলার বিকল্প হয় না। তেমনি একটি মসলার বিবরণ আমি আজকে উপস্থাপন করবো এবং এর বহুবিধ ব্যবহার বাঙালি মানুষের ঘরে যথেষ্ট পরিমাণে সমাদৃত। পেঁয়াজকে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা ও সবজিও বটে। ভাতের সঙ্গে খালি পেঁয়াজ, ছালাদে কাঁচা পেঁয়াজ, ঝালমুড়িতে কাঁচা পেয়াজ, আলুভর্তায়, বেগুন ভর্তায়, শুঁটকি ভর্তায় এর ব্যবহার সবার কাছে সমাদৃত। অধিক হারে ব্যবহার মসলা হিসেবে বেটে পেস্ট বানিয়েই তরকারিকে সুস্বাদু ও রসালুতে পরিণত করে।

পেঁয়াজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় মসলা। এর পাতায় ভিটামিন ‘এ’ বেশি থাকে। তাছাড়া পেঁয়াজের পাতা ও ডাটায় ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। পেঁয়াজ খাবার দ্রুত হজমকারক ও রুচিবর্ধক হিসেবেও এর জুড়ি নেই।

উৎপাদন স্থল : বাংলাদেশের প্রধান প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদন অঞ্চলগুলো হলো- চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রংপুরের মধ্যে অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ফরিদপুর অঞ্চলে।

এর চাষাবাদ পদ্ধতি :বেলে-দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য ভালো, তবে পিএইচ মান ৫.৫ থেকে ৬.৫। এ ফসল চাষের জন্য বারবার চাষ দিয়ে মাটি বেশ ঝুরঝুরে করে নেয়া আবশ্যক। সুনিষ্কাশিত ও উত্তম জৈবপদার্থযুক্ত উর্বর মাটিতে পেঁয়াজ ভালো হয়।

পেঁয়াজের জাত বিন্যাস : তাহেরপুরী, বারি পেঁয়াজ-১ (তাহেরপুরী), বারি পেঁয়াজ-২ (রবি মৌসুম), বারি পেঁয়াজ-৩ (খরিপ মৌসুম) (ক) স্থানীয় জাত (খ) ফরিদপুরী।

বীজ বপন: বীজতলায় বীজ বুনে চারা উৎপন্ন করে সে চারা জমিতে রোপণ করতে হয়। শল্ককন্দ রোপণ করা যায়। বীজ রোপণের জমিতে বীজ বপন করেও পেঁয়াজের চাষ করা হয়।

বীজ হার: বীজ পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ২.৫-৪ কেজি বীজ, কন্দ পদ্ধতিতে প্রায় ৫৫০ কেজি শল্ককন্দ।

চারা উৎপাদন: ৩ মিটার, ৯ মিটার আকারের বীজতলায় জন্য ২০-৩০ গ্রাম বীজের দরকার পড়ে। বীজ বপনের পর বীজগুলোর ৫-৬ সেন্টিমিটার পুরু বালু দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।

বীজ বপনের সময়: অক্টোবর-নভেম্বর মাস বীজতলায় বা জমিতে বীজ বপনের সময়। সরাসরি বীজ সারি করে বোনা উচিত।

রোপণের পদ্ধতি : আমাদের দেশে তিনটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়।
১. জমিতে সরাসরি বীজ ছিটিয়ে
২. বন্ধ বা বালপ রোপণ করে
৩. বীজ থেকে তৈরি চারা সংগ্রহ করে রোপণ।

রোপণ দূরত্ব : সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার। প্রতি সারিতে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব অন্তর ৫-৬টি চারা রাখা যায়। চারা রোপণের ক্ষেত্রে তা করা যায় বীজ বপনের প্রায় এক মাস পর। সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং সারিতে ৪ দূরত্ব ৮-১৬ সেন্টিমিটার রাখতে হবে। শল্ককন্দ রোপণ দ্বারা আগাম শস্য উৎপন্ন করা যায়। বিদেশি বড় জাতের পেঁয়াজের বীজ থেকে যে চারা হয় তা থেকে প্রথম বছর বীজ উৎপন্ন করা যায় না। সাধারণত ১-২ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট পেঁয়াজ ৩-৪০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে পেঁয়াজের জাত অনুসারে ৮-১৬ সেন্টিমিটার ব্যবধানে রোপণ করা যেতে পারে। পেঁয়াজের জমি চাষ দিয়ে মাটি ভেঙে দেয়া আগাছা দমন এবং পানি সেচের ব্যবস্থা করা উচিত।

সার প্রয়োগ: গোবর, সার, খৈল ও টিএসপি সার জমি প্রস্তুতকালে এবং ইউরিয়া ও মিউরেট অব পটাশ সার চারা ১৫-১৮ সেন্টিমিটার উঁচু হওয়ার পর সারির ফাঁকে মালচিংয়ের আগে ছিটিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

পরিচর্যা: গেঁড় লাগানো গাছে যে কলি বের হয় তা শুরুতে ভেঙে দিতে হয়। কলি তরকারি কিংবা সালাদরূপে ব্যবহৃত হতে পারে। বীজের উদ্দেশ্যে পেঁয়াজ ফসলের যে অংশ রাখা হয়, সেখানে ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগকালে হেক্টর প্রতি ১০ কেজি হিসেবে টিএসপি সার দ্বিতীয় দফায় প্রয়োগ করা যায়।

বীজ উৎপাদন: বীজ তৈরি করার উদ্দেশ্যে বীজ অনেক ঘন করে বোনা যায়। ফলে একই জমি থেকে কয়েকগুণ বেশি সংখ্যায় ছোট আকারের পেঁয়াজ পাওয়া যায়। এগুলো সংরক্ষণ করে পরবর্তী বছরে ঘনভাবে রোপণ করলে সে শস্য থেকে বেশি পরিমাণে বীজ পাওয়া যায়।

ভালো বীজ সংগ্রহ ও পরীক্ষাকরণ : অবশ্যই উন্নত ও মেয়াদ সম্পন্ন বীজ ক্রয় করতে হবে। বিএডিসির বীজ কেন্দ্র থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। বীজ পরীক্ষাকরণের জন্য ১৪-১৫ ইঞ্চি লম্বা একটি কলাগাছের বাকল দুই পাশের চিকন পাতলা অংশ ফেলে দিয়ে নিচ থেকে ৩ ইঞ্চি পারিমাণ রেখে বাকি অংশ চিরে নিতে হবে। এর মধ্যে ২৫টি বীজ গুণে ভেতরে ঢুকিয়ে বাকলটি বেঁধে ঘরের নিরাপদ কোনো স্থানে রেখে দিতে হবে। যেন আলো ও বাতাস উভয়ের সংস্পর্শে থাকে। এভাবে ৪/৫ দিন রেখে মাঝে মধ্যে একটু পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। তারপর বাঁধ খুলে গুনে দেখতে হবে কটি বীজ গজিয়েছে। যদি প্রতি দশটি বিজের মধ্যে ৮টি বীজ গজায় তাহলে বোঝা যাবে সেটা ভালো বীজ। বীজ একটি পাতলা সুতি কাপড়ে পুকুরের পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে প্রায় ৩০-৪০ মিনিট। তারপর কাপড়ের পুটলি একটু ঢিলাঢালা করে ম–খ বেঁধে কোনো নিরাপদ যায়গায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

এভাবে ৪৮ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখার পর দেখা যাবে বীজের মুখ ফেটে চারার গেরা বের হচ্ছে। মোটামুটি ৮৫ শতাংশ বীজের মুখ ফাটা দেখা গেলে জমিতে ছিটিয়ে হালকা মই দিয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে। বীজ বপনের কমপক্ষে ১০-১২ দিন সময় লেগে যায় চারা গজাতে। চারা গজানোর ৩৫-৪০ দিন পর চারা ভাঁজ দিয়ে পাতলা করে প্রয়োজনীয় চারা রেখে মাটিতে হাত দিয়ে মালিশ করে দিলে চারার বৃদ্ধি ভালো হয় এবং মাটির রস অনেক দিন থাকে। উত্তোলিত চারা অন্য জমিতে ওই একই পদ্ধতিতে চাষ দিয়ে মাটি জুয়ায়ে (শোধন করে) নিয়ে ভালো করে মই দিয়ে মাটি চাপিয়ে লাঙ্গল টেনে গর্তে চারা বসিয়ে মাটি ভরাট করে দিতে হয়। এক্ষেত্রে চারা থেকে চারার দূরত্ব ১০-১৫ সেমি. এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩০ সেমি.। লক্ষ্য রাখতে হবে, চারার সবুজ অংশ অবশ্যই মাটির ওপরে থাকতে হবে। নয়তো চারা পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর বাকি চারা বাজারে বিক্রি করে ভালো অর্থ পাওয়া যায়। অন্যভাবে বীজ থেকে চারা উৎপাদনের জন্য ৩ত্র১ মিটার বীজতলা তৈরি করে মাটি শোধন করে নিন।

ফলন :দেশি পেঁয়াজের হেক্টরপ্রতি ফলন ৭-১৫ টন।

ফসল সংগ্রহ: পেঁয়াজের গাছ নিজে নিজে শুকিয়ে যায়। তখন পেঁয়াজ ভালোভাবে পরিপক্ব হয় এবং ওঠানোর উপযোগী হয়।

সংরক্ষণ :পেঁয়াজ ভালো করে শুকানোর পরে গুদামজাত করতে হয়। গুদাম ঠান্ডা ও বায়ু চলাচলের ব্যবস্থাযুক্ত হওয়া উচিত।
গুদামে পরীক্ষা করে পচা ও রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হয়।
ঠান্ডা গুদামে ৩৪ ফা. তাপে এবং শতকরা ৬৪ ভাগ আর্দ্রতায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়।
গেঁড় এর বেলায় এদের শেষের কয়েক সপ্তাহ ৭ ডিগ্রি হতে ১২.৭ ডিগ্রি সিলসিয়াস তাপে রাখা উত্তম।

পোকা দমন : থ্রিপস পোকা পেঁয়াজের পাতার রস শোষণ করে। এগুলোকে ০.০৫ ভাগ শক্তির ডাইমেক্রন বা সেভিন ছিটিয়ে দমন করা যায়। টিইপিপি প্রয়োগেও উপকার পাওয়া যায়।

রোগ দমন: গুদামে ও স্থানান্তর কালে ধূসর পচা রোগে পেঁয়াজের ঘাড়ের দিক পচে যায়। সেজন্য জমি থেকে সাবধানে পেঁয়াজ তুলতে হয় এবং গুদামজাত করার আগে পেঁয়াজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়।

বারি পেঁয়াজ-১ এর উৎপাদন পদ্ধতি

onion farmingমাটি : দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য ভাল।

আবহাওয়া : ১৫-২৫ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা পেঁয়াজের শল্ককন্দ উৎপাদনের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী।

বপন ও রোপণ পদ্ধতি এবং সময় : পেঁয়াজ সরাসরি বীজ বুনে, শল্ককন্দ ও চারা রোপণ করে উৎপাদন করা হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলায় বপন করতে হবে।

বীজতলা তৈরি ও বীজের পরিমাণ : বীজতলা ৩´১ মিটার আকারের হতে হবে। প্রতি বীজতলায় ২৫-৩০ গ্রাম হিসেবে বুনতে হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে চারা উৎপাদনের জন্য ১২-১৩০টি (৩´১) মিটার বীজতলার প্রয়োজন হবে। অপরদিকে সরাসরি জমিতে বীজ বুনলে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৬-৭ কেজি বীজের প্রয়োজন হবে। কন্দের আকারভেদে হেক্টরপ্রতি ১২০০-১৫০০ কেজি শল্ককন্দের প্রয়োজন হয়।

জমি তৈরি ও চারা রোপণ : জমি গভীর চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বেছে, মাটির ঢেলা ভেঙে সমতল করে তৈরি করতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : হেক্টরপ্রতি ২৫০-২৬০ কেজি ইউরিয়া, ১৮০-২০০ কেজি টিএসপি, ১৪০-১৬০ কেজি এমপি এবং ৭-১০ টন গোবর সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। শেষ চাষের সময় সবটুকু গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি এবং ইউরিয়া ও এমপি সারের অর্ধেক পরিমাণ জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর দুই কিস্তিতে ক্ষেতে প্রয়োগ করতে হবে। শল্ককন্দ বা সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করার ক্ষেত্রেও মোটামুটিভাবে এ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : পেঁয়াজের জমিতে মাটির প্রয়োজনীয় রস না থাকলে প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর পানি সেচ আবশ্যক। তবে পেঁয়াজ সংগ্রহের দুই সপ্তাহ আগে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসলের ফুলের কলি হওয়ামাত্রই তা ভেঙে দিতে হবে। পেঁয়াজ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সুতরাং পেঁয়াজের জমি থেকে পানি সরে যাবার সুবিধা থাকতে হবে।

এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।