সংকর জাতের বাছুর

সংকর জাতের বাছুরের পরিচর্যা

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিজ উত্পাদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল পশুসম্পদ। দেশে গবাদিপশুর অনুন্নত জাত হওয়ার কারণে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে উত্পাদনের যোগান হচ্ছে না। তাই সুপরিকল্পিতভাবে জাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে পশুসম্পদের অবদানকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য দুগ্ধ খামারের উন্নতিকল্পে একটি সুষ্ঠু প্রজনন নীতি অনুসরণের মাধ্যমে দেশি গাভী থেকে সংকর জাতের বাছুর উত্পাদন সর্বোত্তম। সাধারণত দু’ ধরনের পদ্ধতিতে সংকর জাতের বাছুর পালন করা যায়।

১) গাভীর সঙ্গে বাছুর পালন এবং
২) গাভী থেকে পৃথক রেখে বাছুর পালন।

গাভী থেকে পৃথক রেখে বাছুর পালন পদ্ধতিতে জন্মের প্রথম ৪ দিন বাছুরকে তার মায়ের শাল দুধ খাওয়ানোর পর মা হতে পৃথক করে রাখতে হয়। অবশ্য অনেক খামারে শাল দুধ থাকা পর্যন্ত বাছুরকে গাভীর সাথে রাখা হয়। পরে পৃথকভাবে দুধ খাওয়ানো এবং অন্যান্য যত্ন ও পরিচর্যা করা হয়। এ পদ্ধতিকে উয়িনিং পদ্ধতি বলে। খামারের পালিত বাছুরকে এ পদ্ধতিতে পালন করা হয়। এ পদ্ধতির সুবিধা হল বাছুরকে তার চাহিদামত দুধ খাওয়ানো যায়। প্রয়োজনে অতিরিক্ত দুধ খাওয়ানো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অপরদিকে গাভীকে বাছুরের সঙ্গে রাখলে বাছুর দিনে কতটুকু দুধ খায় তা সঠিকভাবে জানা যায় না। এ পদ্ধতিতে বাছুরের অন্ত্রের অনেক রোগ যেমন- ডায়রিয়া, কলিবেসিলসিস ইত্যাদি দমন করা যায়। উয়িনিং পদ্ধতিতে গাভীর প্রকৃত দুধ উত্পাদন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বাছুর ছাড়াই দুধ দোহনের ফলে স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন দুধ পাওয়া যায়।

সুস্থ সবল বাছুর পেতে হলে গর্ভাবস্থায় গাভীর সুসম খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিশেষ যত্ন নিতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পর পরই এর নাক ও মুখের লালা ও ঝিল্লি পরিষ্কার করে দিতে হবে। যদি বাছুর প্রসব হওয়ার পর শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয় তবে এর বুকের পাঁজরের হাড়ে আস্তে আস্তে কয়েকবার চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া বাছুরের নাক, মুখে ফুঁ দিয়েও শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করা যায়। নাক-মুখ পরিষ্কার করার পর গাভীর সামনে রাখলে গাভী চেটে বাচ্চার গা পরিষ্কার করে। যদি কোনো কারণে গাভী না চাটে তবে শুকনো নরম খড়, কাপড় অথবা চট দিয়ে বাছুরের গা ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনো ভাবেই নবজাত সংকর জাতের বাছুরের শরীর পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। বাছুরের নাভীরজ্জু দেহ থেকে ১-২ ইঞ্চি বাড়তি রেখে পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত কেঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে এবং কাটা স্থানে টিংচার আয়োডিন বা টিংচার বেনজিন লাগাতে হবে। জন্মের প্রথম ৬ মাস বাছুর পালন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বয়সে বাছুর অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। ক্রুটিপূর্ণ খাদ্য ও যত্নের কারণে বাছুরের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুও ঘটতে পারে।

বাছুরকে তার মায়ের দুধ খাওয়ানো উত্তম। দুধ দোহনের পর পরই বাছুরকে দুধ খেতে দিতে হবে। কারণ দুধ দোহনের সময় দুধের তাপমাত্রা শরীরের তাপমাত্রায়, যেমন ৯০-১০০০ ফা: এ থাকে। পরে তাপমাত্রা হ্রাস পায় যা বাছুর পছন্দ করে না। তাই দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তা গরম করে ৯০-১০০০ ফা: তাপমাত্রায় বাছুরকে খেতে দিতে হবে।

যদিও মায়ের দুধের বিকল্প নেই তবুও বাজারে দুধের মূল্য বেশি হলে খামার মালিক বাছুরকে পরিমিত দুধ দেওয়া থেকে বঞ্চিত করে। এক্ষেত্রে বাছুরকে গাভীর দুধের পরিবর্তে যে বিশেষ সুষম তরল খাদ্য খাওয়ানো হয় তাকে দুধের বিকল্প খাদ্য বলা হয়। সাধারণত দুধের বিকল্প খাদ্য বাছুরের ১৫ দিন বয়স থেকে খাওয়ানো হয়। প্রায় ১ লিটার দুধের পরিবর্তে ২০০ গ্রাম বিকল্প পাউডার ১ লিটার ফুটন্ত পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। সংকর জাতের বাছুরের ১০০ কেজি মানের দুধের বিকল্প খাদ্য তৈরিতে ১০ কেজি গমের আটা, ১২ কেজি শুটকি মাছের গুঁড়া, ৪০ কেজি তিসির তেল, ১৩ কেজি গুঁড়া দুধ, ১০ কেজি নারিকেল তেল ০.৩০ কেজি বিউটারিক এসিড, ১.৫০ কেজি সাইট্রিক এসিড, ১০ কেজি লালি গুঁড়া, ৩ কেজি প্রিমিক্স ও ০.২০ কেজি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন।

সুস্থ সবল সংকর জাতের বাছুরের ঘর নির্মাণে খেয়াল রাখতে হবে ঘরে যেন অবাধে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকে। ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখা বাঞ্চনীয়। ঘর সর্বদা পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখতে হবে। ঘরের মেঝে পাকা হওয়া আবশ্যক। মেঝে পাকা হলে তা পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখা সহজ হবে। মূল ঘরের সঙ্গে বেড়া দেওয়া অতিরিক্ত কিছু খোলা জায়গা রাখতে হবে যা দিনের বেলায় বাছুরের ব্যায়ামের জন্য ব্যবহার হবে। প্রতিটি বাছুরের জন্য ৪ ফুট বাই ৮ ফুট জায়গা থাকা প্রয়োজন। এদের জন্য পৃথক দানাদার খাদ্যের বাক্স ও একটি ঘাস রাখার র্যাক থাকা প্রয়োজন। জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতিটি সংকর জাতের বাছুরের খাদ্য তালিকা আমাদের জেনে রাখা ভাল।

জন্মের ১ম সপ্তাহে বাছুরকে সকালে ১ লিটার ও বিকালে ১ লিটার দুধ খাওয়াতে হবে। জন্মের ২য় সপ্তাহে বাছুরকে সকালে ১.৫ লিটার ও বিকালে ১.৫ লিটার দুধ খাওয়াতে হবে। সেই সাথে কিছু দানাদার খাদ্য ও কচি ঘাস দেওয়া যেতে পারে। জন্মের ৩য় সপ্তাহ হতে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত বাছুরকে সকালে ২ লিটার ও বিকালে ২ লিটার দুধ খাওয়াতে হবে এবং আধা (১/২) কেজি দানাদার খাদ্য ও ১ কেজি কচি ঘাস দিতে হবে। জন্মের ১৩ সপ্তাহ হতে ১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বাছুরকে সকালে ১.৫ লিটার ও বিকালে ১.৫ লিটার দুধ খাওয়াতে হবে সেই সাথে ৭৫০ গ্রাম দানাদার ও ৩ কেজি কচি ঘাস খাওয়াতে হবে। ১৭ সপ্তাহ হতে ২০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাছুরকে সকালে ১ লিটার ও বিকালে ১ লিটার দুধ খাওয়াতে হবে এবং ১ থেকে দেড় কেজি দানাদার ও ৭ কেজি কাচা সবুজ ঘাস খাওয়াতে হবে। আবার ২১ সপ্তাহ হতে ২৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত সংকর জাতের বাছুরকে সকালে আধা (১/২) লিটার ও বিকালে আধা (১/২) লিটার দুধ খাওয়াতে হবে সেই সাথে ১ থেকে দেড় কেজি দানাদার এবং ৭ কেজি কাঁচা সবুজ ঘাস খাওয়াতে হবে।

সংকর জাতের বাছুরকে খাওয়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ হল: বাছুরকে পর্যাপ্ত শালদুধ ও দুধ খাওয়াতে হবে; দেহের তাপমাত্রায় দুধ বাছুরকে খাওয়াতে হবে। সে তাপমাত্রা হতে পারে ৯০-১০০০ ফা:; সুস্থ বাছুরকে খাওয়ানোর পর অসুস্থ বাছুরকে খাওয়াতে হবে; সংকর জাতের বাছুরের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে; বাছুরের খাবার পাত্র পরিষ্কার রাখতে হবে; অতিরিক্ত তরল দুধ বাছুরকে খাওয়ানো উচিত নয়; সংকর জাতের বাছুরের জন্য উচ্চমানের পর্যাপ্ত ঘাস ও খড় সরবরাহ করতে হবে।
লেখক: ডাঃ সুমন তালুকদার রুনু সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
এগ্রোবাংলা ডটকম