স্টেম কাটিং প্রযুক্তির আলু বীজ

স্টেম কাটিং প্রযুক্তির আলু বীজ

আলু চাষে সবচেয়ে বেশি খরচ বীজের। দেখা যায়, আলু চাষে বীজের জন্য প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ হয়। এক বিঘা জমিতে আবাদ করতে তিন থেকে পাঁচ কেজি ধান বীজ বা এক কেজি পাটের বীজ প্রয়োজন হয়, অথচ আলু চাষে দরকার হয় প্রায় ২০০ কেজি বীজ।

প্রতিবছর যে পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হয়, তার জন্য প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টন বীজ আলুর দরকার হয়। বিএডিসি এবং অন্যান্য বীজ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, বিদেশ থেকে আমদানি করে এই চাহিদা পূরণ করে থাকে। এ রকম অবস্থায় ‘স্টেম কাটিং’ প্রযুক্তির প্রয়োগ করে দেশেই মানসম্পন্ন বীজ আলুর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

স্টেম কাটিং কী? আলু গাছের কাণ্ডের অগ্রভাগ থেকে কাণ্ড সংগ্রহ করে সেই কাণ্ড থেকে আরেকটি গাছ জন্মানো যায়। বীজ আলু উৎপাদনের দ্রুতবর্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে স্টেম কাটিং পদ্ধতি অন্যতম। স্টেম কাটিং পদ্ধতি অনেকটা চন্দ্রমলি্লকা এবং ডালিয়া ফুলের বংশবিস্তার যেভাবে ঘটানো হয়, ঠিক সে রকম।

কেন স্টেম কাটিং বীজের জন্য কোনো খরচ ছাড়াই বা কম খরচে একজন চাষি খুব সহজেই কাঙ্ক্ষিত মানের প্রয়োজনীয় পরিমাণ আলু গাছ বা বীজ উৎপাদন করতে পারবেন। ফলে বীজের জন্য চাষিকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না। মাতৃ আলুর সঙ্গে কাণ্ডের কোনো সংযোগ থাকে না, এ জন্য অনেক বীজ এবং মাটিবাহী নন-সিস্টেমিক রোগ যেমন নেমাটোড, ছত্রাকঘটিত এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত উইল্ট প্রভৃতি রোগমুক্ত বীজ আলু উৎপাদন করা সম্ভব। আলু ক্ষেতের অন্যতম শত্রু ভাইরাস সংক্রমণ। এই পদ্ধতিতে আলু চাষ করলে ভাইরাসমুক্ত আলু উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ আলু গাছের যে স্থান থেকে কাণ্ড সংগ্রহ করা হয়, সেখানে কিছু ভাইরাসের উপস্থিতি থাকলেও তা পরে খুব একটা বিস্তার ঘটাতে পারে না। এ ছাড়া সুস্থ-সবল গাছ থেকে কাণ্ড সংগ্রহ করা হলে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে না।

এক বিঘা জমিতে প্রায় ১২-১৩ হাজার পর্যন্ত বীজ আলুর খণ্ড থাকে। গাছ জন্মানোর পর জমিতে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার কাণ্ড পাওয়া যায়। যখন আলু গাছের ২৫ থেকে ৩০ দিন হয়, তখন সতেজ গাছ থেকে একটি করে কাণ্ড কেটে নিতে হবে। এভাবে দুই হাজার কাণ্ড সংগ্রহ করা যায়। এই কাণ্ডগুলো রুটিং হরমোনে ট্রিটমেন্ট করে বেডে বা মোটা বালুতে লাগাতে হবে। এর পর ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মূল জমিতে রোপণ উপযোগী কাটিং-চারা হয়ে উঠবে। ডায়মন্ড, কার্ডিনাল এবং গ্রানুলা জাতের আলুর কাণ্ডে ৯০ শতাংশের বেশি শেকড় গজায়। তবে ৭৫ শতাংশ কাণ্ডে শেকড় বের হলে কাটিং-চারা জমিতে লাগানো যাবে।

কাণ্ড সংগ্রহ জাতভেদে গাছের বয়স যখন ২৫ থেকে ৩০ দিনের হয় তখন কাণ্ড সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। এক-দুই ইঞ্চি লম্বা কাণ্ড সংগ্রহ করতে হবে। বিকেলের দিকে কাণ্ড সংগ্রহ করা ভালো। বেডে কাণ্ডগুলোকে দুই-আড়াই ইঞ্চি দূরত্বে রোপণ করতে হবে। রোপণের ১২ থেকে ১৫ দিন পর মূল জমিতে রোপণ উপযোগী কাণ্ড-চারা পাওয়া যায়। কাণ্ড-চারা সংগ্রহের ৩০ মিনিট আগে ঝরনা দিয়ে বেডে ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।

রুট হরমোন না থাকলে মোটা বালিতে থালাটবের কাণ্ডে শেকড় গজিয়ে নেওয়া যেতে পারে। শেকড় গজাতে চার-পাঁচ দিন বেশি সময় লাগে এবং শেকড়ের সংখ্যা কিছু কম থাকে। একটি ১০ ইঞ্চি মাপের মাটির থালাটবে ৪০টি পর্যন্ত কাটিং বসানো যায়।

জমিতে রোপণ লাইন করে বা বেডপদ্ধতি উভয়ভাবেই কাণ্ড (চারা) রোপণ করা যায় । পরিমাণমতো টিএসপি, অর্ধেক ইউরিয়া এবং অর্ধেক পটাশ নালায় প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে কাণ্ড রোপণ করতে হবে। বোরন, জিঙ্ক, জিপসাম স্বাভাবিকভাবে আলু চাষের মাত্রানুযায়ী শেষ চাষের আগে প্রয়োগ করতে হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২২ ইঞ্চি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ছয় ইঞ্চি রাখা ভালো। স্টেম কাটিংয়ের জন্য বেলে বা বেলে দো-আঁশ ধরনের হালকা বুনটের মাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী। যদি বেড পদ্ধতিতে তিন বা চার লাইনে কাণ্ড লাগানো যায়, তবে একক জমিতে অধিকসংখ্যক কাণ্ড বসানো যাবে। ফলে ফলন আরো বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে এবং বীজের আকারও ভালো হবে।

চারার যত্ন চারা মাটিতে না লাগা পর্যন্ত ঝরনা দিয়ে পানি দিতে হবে। প্রথমবার এমনভাবে পানি দিতে হবে, যেন চারার শেকড়ের সঙ্গে মাটি সংযোগ খুব ভালোভাবে হয়। এরপর চার-পাঁচ দিন সকাল এবং বিকেলে হালকাভাবে পানি দিতে হয়। গাছ লেগে গেলে জমিতে ভাসাভাবে সেচ দিতে হবে (যেভাবে গমের জমিতে সেচ দিতে হয়), তবে খেয়াল রাখতে হবে, পানি যেন খুব বেশি না দেওয়া হয়। জমিতে ‘জো’ আসার পর নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে কুপিয়ে লাইনের মাঝখান থেকে গাছের গোড়ায় দিয়ে ভেলি করে দিতে হবে। এ সময় প্রয়োজনমতো ইউরিয়া ও পটাশ সার দিতে হবে।

পানি সেচ প্রথমবার ভাসাভাবে সেচ দেওয়ার পর যখন জমিতে জো আসবে তখন কুপিয়ে আলু গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিলে একটি নালার সৃষ্টি হবে। জমির রসের অবস্থা বুঝে এই নালার মাধ্যমে সেচ দিতে হবে।

গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়াগাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। সাধারণত টপ ড্রেসিংয়ের পর দুই বার মাটি তুলে দিতে হয়। বীজ আলু উৎপাদনের অন্য বিষয়গুলো যেমন স্প্রে শিডিউল অনুসরণ, রোগিং, হামপুলিং কাজগুলো স্বাভাবিকভাবে করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে আবাদ করা বীজ আলু যেভাবে সংগ্রহ করা হয়, সেই একইভাবে বীজ আলু সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক সময়ে কাণ্ড রোপণ করতে পারলে স্টেম কাটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে একরপ্রতি ১০ টন পর্যন্ত বীজ আলু আমাদের দেশে উৎপাদন করা সম্ভব।

লেখক: মো. আরিফ হোসেন খান
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।