আমন ধানে পোকা

আমন ধানে পোকার আক্রমণ ও প্রতিকার

আমন ধানে পোকা লেগেছে। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের কিছু জমিতে বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণ দেখা গেছে। পাবনাসহ কিছু জায়গায় মাজরা পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ফেনীসহ কিছু এলাকায় আবার পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণের খবর বেরিয়েছে। আক্রান্ত আমন ক্ষেতের চাষি ভাইয়েরা বড়ই চিন্তার মধ্যে আছেন। এ অবস্খায় কী করবেন?

বাদামি গাছফড়িং নিয়ন্ত্রণে করণীয় : আমন ধানের জমি তৈরির সময় বেশি পানি ব্যবহার করায় জমি খুব ভালোভাবে সমতল করা হয় না। তাই পরে যখন ইউরিয়া সার দেয়া হয় তখন পানি কমে এলে সারের খানিকটা পানির সাথে গিয়ে নিচু জায়গায় জমা হয়। ফলে জমির নিচু জায়গায় জমে থাকা পানি ও সারের প্রভাবে গাছের বাড়বাড়তি উঁচু অংশের তুলনায় বেশি হয়। কুশি বেশি হয়ে গাছ ঝোপালো হয়ে যায়। পটাশ, দস্তা, জিপসাম ইত্যাদি সার প্রয়োগ না করায় বা কম দেয়ায় ধানগাছের বালাইয়ের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, গাছ কম শক্ত হয়। ফলে গাছে সহজেই বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণ হয়। বাদামি গাছফড়িং খুব ছোট পোকা, বাদামি রঙের এবং দলবেঁধে ধান গোছার গোড়ার দিকে থাকে। গোড়ার পাতার খোল থেকে বাদামি গাছফড়িং ও তার বাচ্চা দলে দলে গাছের রস চুষে খায়। ফলে গাছ হলুদ রঙ ধারণ করে ও শুকিয়ে যায়। সাধারণত বাদামি গাছফড়িং যেখানে লাগে সেখানে চাকের মতো খানিকটা জায়গার ধানগাছ শুকিয়ে ফেলে। দূর থেকে দেখলে বাজ পোড়ার মতো মনে হয়। অর্থাৎ এ পোকার আক্রমণে ক্ষেতের মাঝে মাঝে তাওয়ার মতো লালচে হয়ে ধানগাছ বসে যায়।

এ অবস্খায় কোনোভাবেই জমিতে আর ইউরিয়া সার দেয়া ঠিক নয়। সম্ভব হলে জমে থাকা পানি ক্ষেত থেকে বের করে দিতে হবে। মরে যাওয়া বা আক্রান্ত গাছের খোলপাতা হাতে টেনে পরিষ্কার করে জমিতে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্খা করতে হবে। এ জন্য চার থেকে পাঁচ সারি পরপর ধানগাছের সারি বরাবর বিলি কেটে ফাঁকা করে দিতে হবে। তাওয়া ধরে পুড়ে যাওয়া অংশে অবশ্যই বাদামি গাছফড়িংয়ের আস্তানা থাকে। তাই সে অংশে ও তার খানিকটা আশপাশের গাছের গোড়ায় ভালো করে ভিজিয়ে অনুমোদিত কীটনাশক যেমনন্ধ মিপসিন, সপসিন, অসবেক, ম্যালাথিয়ন, ফেনিট্রথিয়ন ইত্যাদি স্প্রে করতে হবে। আক্রমণের মাত্রা খুব বেশি হলে পুরো ক্ষেতে ফুরাডান ৫জি বা ফিপ্রোনিল ৩জি (প্রতি বিঘায় ১.৩ কেজি হারে) ছিটিয়ে দিন।

মাজরা পোকা নিয়ন্ত্রণে করণীয় : মাজরাপোকা ধানগাছের গোড়ায় কুশি ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে মাইজ বা ডিগপাতা কেটে দেয়। ফলে ডিগপাতা মরে যায়। একে বলে ‘মরা ডিগ’। শীষ বের হওয়া বা দানা গঠনপর্যায়ে মাজরা পোকার আক্রমণে আক্রান্ত শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায় ও খাড়া থাকে। একে বলা হয় ‘সাদা শীষ’। যদি কুশি বৃদ্ধিপর্যায়ে শতকরা ১০ ভাগ ডিগপাতাও মাজরার আক্রমণে এভাবে মরে যায় তাহলেও চাষি ভাইদের চিন্তার কিছু নেই। কেননা কিছু দিনের মধ্যেই গাছ নতুন কুশি ছেড়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ চাষিভাই দুই থেকে তিন শতাংশ বা পাঁচ থেকে ছয়টি গুছিতে একটা মরা ডিগ দেখলেই চিন্তায় মরে যান। অযথা কীটনাশক ছিটিয়ে টাকা নষ্ট করেন। যেসব ডিগ বা কুশি মরে গেছে, হাজার কীটনাশক দিলেও সেগুলো আর জীবিত হবে না।

মাজরা পোকা আসে দফায় দফায়, ঝাঁকে ঝাঁকে। তাই একবারে তারা যে ডিম পেড়ে রেখে যায় সে ডিম ফুটেই মাজরার বাচ্চা বের হয় ও কুশির বা পাশকাঠির গোড়ায় ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে কুশি নষ্ট করে দেয়। কাজেই ক্ষতির লক্ষণ দেখা দেয়ার পর অযথা কীটনাশক স্প্রে করে কোনো লাভই হয় না। তাই আগে থেকেই সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্খা নিতে পারলে আক্রমণ অনেক কমে যায়। ফসলও ক্ষতি হওয়া থেকে বাঁচে। সে জন্য চারা লাগানোর পরই ক্ষেতে পাখি বসার জন্য ডাল বা কঞ্চি পুঁতে দিলে তাতে ফিঙেসহ অন্যান্য পাখি বসে মাজরা পোকা ধরে খায়। ফলে মা মাজরা ধানগাছের পাতায় আর ডিম পাড়তে পারে না। একটা ফিঙে পাখি রোজ গড়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০টা মা মাজরা ধরে খেতে পারে। একটা মা মাজরা ১০০ থেকে ১৫০টা ডিম পাড়ে। এর যদি অর্ধেকও ফুটে বাচ্চা বের হয় ও কুশি ছিদ্র করে ঢোকে, তবে একটা মা মাজরার বাচ্চা ৫০ থেকে ৭৫টা কুশি নষ্ট করে দিতে পারে।

তাই ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্খা করলে এবং ক্ষেতে কোনো কীটনাশক স্প্রে না করলে মাজরা নিয়ন্ত্রণের জন্য আর কোনো ব্যবস্খা নেয়ার দরকার হয় না। আক্রান্ত ক্ষেতে মরা ডিগ বা সাদা শীষ দেখলে ক্ষেতে নেমে প্রথমেই সেগুলোর মাথা ধরে টান দিয়ে তুলে ফেলুন। তবে তুলে ফেলা ওসব মরা ডিগ বা সাদা শীষ ভুলেও কখনো জমিতে বা আইলে ফেলে রাখবেন না। মাটিতে পুঁতে ফেলুন, না হয় পুড়িয়ে ফেলুন। জমিতে বা আশপাশে ফেলে রাখলে সেখান থেকে আবার জমিতে যাবে ও নতুন কুশি আক্রমণ করবে। যদি গাছ কুশি অবস্খায় থাকে বা থোড় না হয়, তাহলে ক্ষেতে এক কিস্তি ইউরিয়া সার দিন। সাথে ফুরাডান, বাসুডিন ইত্যাদি দানাদার কীটনাশক ছিটিয়ে দিতে পারেন। তবে কীটনাশক স্প্রে করবেন না। সম্ভব হলে দু-চার দিন সìধ্যায় জমি থেকে কিছুটা দূরে আলোকফাঁদ পাতুন। এতে মা মাজরা আলোতে আকৃষ্ট হয়ে মারা যাবে। সবশেষে মাজরা মারার একটা মন্ত্র বলে দিই, মন্ত্রটা হলোন্ধ ‘দিনে লাঠি (কঞ্চি) সìধ্যায় বাতি, এই হলো মাজরা মারার কেরামতি।

যে জিনিসগুলো অবশ্যই মনে রাখবেন
১. বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণ খুব বেশি হলে জমিতে আর ইউরিয়া সার দেবেন না। ক্ষেতে পানি জমে থাকলে বের করে দিতে হবে।
২. মাজরা পোকায় আক্রান্ত ক্ষেতে অযথা কীটনাশক ছিটিয়ে টাকা নষ্ট করবেন না। কারণ মরে যাওয়া ডিগ বা কুশি হাজার কীটনাশক দিলেও জীবিত হবে না।
৩. তুলে ফেলা মরা ডিগ বা সাদা শীষ ভুলেও কখনো জমির আইলে ফেলে রাখবেন না। ওগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলুন, না হয় পুড়িয়ে ফেলুন।
৪. দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করলেও কোনো তরল কীটনাশক স্প্রে করবেন না। তাতে মাজরার ডিম, কিড়া ও পুত্তলির পরজীবিতার মাধ্যমে যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বোলতা প্রাকৃতিকভাবে নষ্ট করে, সেসব বোলতা মরে যাবে।
৫. দিনে লাঠি (কঞ্চি) সনধ্যায় বাতি, এই হলো মাজরা মারার কেরামতি।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম

ধানে পোকার আক্রমণ ঠেকাতে পার্সিং পদ্ধতি

পার্সি

আমন ক্ষেতে পোকার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ধানের জমিতে কিছুদূর পর পর গাছের ডাল পুঁতে দেয়া হয়। ওই ডালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পাখি বসর এবং ধান ক্ষেতের পোকা খেয়ে ফেলে। এভাবে কীটনাশক ছাড়াই পোকার আক্রমণ থেকে ধান ক্ষেত রক্ষা করা যায়। এর ফলে তাদের রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। এতে একদিকে আর্থিক সাশ্রয় হয়, অপরদিকে কৃষকরা পরিবেশবান্ধব শস্য ফলাতে পারে।

ফসলের জমিতে পাখি বসার উপযোগী ডাল পুঁতে পোকা দমন করার এই পদ্ধতির নাম পার্সিং । অল্প সময়ের মধ্যে পদ্ধতিটি কৃষকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
এগ্রোবাংলা ডটকম

আমন ধানের ক্ষতিকর বাদামী গাছ ফড়িং

বাদামি গাছফড়িং

মাঠে মাঠে আমন ধান। সবুজ এ ধানের অন্যতম শত্রু বাদামী গাছ ফড়িং। এরা পাতার খোল, পাতা ও পাতার মধ্যশিরার ভেতরে ডিম পাড়ে। চার থেকে নয় দিনের মধ্যে ডিম থেকে নিম্ফ বের হয়। প্রথম পর্যায়ে নিম্ফগুলোর রঙ সাদা থাকে এবং পরে বাদামী রঙের হয়। নিম্ফ থেকে পূর্ণবয়ষ্ক ফড়িং এ পরিণত হতে ১৪ থেকে ২৬ দিন সময় লাগে। বীজতলা থেকে শুরু করে ধান পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত যেকোনো সময়ে এ পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। তবে ধানগাছে কাইচথোড় আসলে এর আক্রমণ বেড়ে যায়। এক জোড়া বাদামী গাছ ফড়িং ৩ থেকে ৪ প্রজন্মে ৩৫ লক্ষ পোকার জন্ম দিতে পারে এবং ৫০০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে পারে। এরা শরীরের ওজনের তুলনায় ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি খাবার খায়। দ্রুত বংশ বৃদ্ধির কারণে মাঠের পর মাঠ ফসলের ২০ থেকে ১০০% পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে।

আক্রমণের লক্ষণ: বাদামী গাছ ফড়িং-এর বাচ্চা ও পূর্ণবয়ষ্ক উভয় পোকা দলবদ্ধভাবে ধান গাছের গোড়ার দিকে অবস্থান করে গাছ থেকে রস খায়। আর এ কারণে গাছ দ্রুত শুকিয়ে যায়। বাদামী গাছ ফড়িং -এর তীব্র আক্রমণে গাছ প্রথমে হলুদ ও পরে শুকিয়ে যায়, ফলে দূর থেকে পুড়ে যাওয়ার মত বা বাজ পড়ার মত দেখায়। এ ধরনের ক্ষতিকে ‘হপার বার্ণ’ বলে।

অনুকূল পরিবেশ:
১. অধিক সংখ্যক কুশি উত্পাদনশীল উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ করলে;
২. জমি অসমতল হলে নিচু স্থানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। প্রখর সূর্যের তাপে উক্ত পানি বাষ্পিভূত হয়ে উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা তৈরি হয় যা বাদামী গাছ ফড়িং -এর বংশবৃদ্ধি ও আক্রমণের জন্য অনুকূল পরিবেশ;
৩. চারা ঘন করে রোপণ করলে, জমি স্যাঁতস্যাঁতে হলে এবং জমিতে দাঁড়ানো পানি থাকলে;
৪. জমিতে বিকল্প পোষক আগাছা থাকলে;
৫. অসম হারে নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া সার) ব্যবহার করলে;
৬. বাতাস চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে।

দমনে করণীয়:
১. এলাকার সকল চাষিকে দলবদ্ধভাবে পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে;
২. এ কাজে আইপিএম/আইসিএম ক্লাবসহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
৩. প্রতি ব্লকে দলীয় আলোচনার মাধ্যমে সচেতনা সৃষ্টি এবং বাদামী গাছ ফড়িং দমনের কলাকৌশল কৃষকদের মাঝে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে;
৪. বীজতলায় এ পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে, সে জন্য নিয়মিত বীজতলা পরিদর্শন, আলোর ফাঁদ পেতে পোকার উপস্থিতি নির্ণয় করতে হবে;
৫. জমির আইল পরিস্কার রাখতে হবে;
৬. পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে। আক্রান্ত জমির পানি সরিয়ে দিয়ে ৭ থেকে ৮ দিন জমি শুকনো রাখতে হবে;
৭. আক্রান্ত জমিতে ২ থেকে ৩ হাত দূরে দূরে ‘বিলিকেটে’ জমিতে সূর্যের আলো ও বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে;
৮. শুধুমাত্র ইউরিয়া ব্যবহার না করে সুষম মাত্রায় ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ব্যবহার করতে হবে। ইউরিয়া কম ব্যবহার করতে হবে (ধাপে ধাপে ব্যবহার করতে হবে);
৯. বালাই সহনশীল জাতের (ব্রিধান ৩১, ব্রিধান ৩৫, বিনা ধান ৬) চাষ করতে হবে;
১০. জমিতে হাঁস ছেড়ে পোকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে;
১১. স্বল্প জীবনকালীন ফসলের চাষ করতে হবে এবং আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ আপাতত বন্ধ রাখতে হবে;
১২. চারা ঘন করে না লাগিয়ে সারি থেকে সারি ২৫ থেকে ৩০ এবং চারা থেকে চারা ২৩ থেকে ২৫ সে.মি. দূরত্বে রোপণ করতে হবে;
১৩. সন্ধ্যাবেলা আক্রান্ত জমি থেকে একটু দূরে আলোর ফাঁদ জ্বালিয়ে পোকা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে;
১৪. প্রতি গোছায় ২ থেকে ৪টি গর্ভবতী বাদামী গাছ ফড়িং বা ৮ থেকে ১০টি নিম্ফ দেখা গেলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় ধান গাছের গোড়ার দিকে ভালভাবে সেপ্র করতে হবে; কিন্তু গাছে যদি একটি করে মাকড়সা থাকে তবে কীটনাশক ব্যবহার করা ঠিক হবে না।
লেখক: মুহাম্মদ শাহাদত্ হোসাইন সিদ্দিকী

এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।