সম্ভাবনাময় নাশপাতি চাষ

পর্ব-১: পাহাড়ি জমিতে নাশপাতি চাষ

নাশপাতির ইংরেজি নাম Pear. এটি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল। গাছ ১২ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। শীতে পাতা ঝরে। গ্রীষ্মে একসঙ্গে ফুল ও পাতা আসে। ফুলের রং সাদা, ডালের যেকোনো প্রান্তে গুচ্ছবদ্ধভাবে ফোটে। ফুলের অবারিত প্রস্ফুটন-প্রাচুর্য দারুণ উপাভোগ্য। ফল দেখতে অনেকটা পেয়ারার আকৃতির।

ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও আমাদের দেশে সহজলভ্য জাতটি বরাবরই খয়েরি রঙের। জংলি নাশপাতিগাছের চারা তৈরি করে তাতে ভালো জাতের নাশপাতির চোখ কলম করে চারা তৈরি করা যায়। এতে ফলন ভালো হয়। তবে সঠিক সময়ের আগে ফল তুললে টক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে ফল পাড়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এশিয়ায় নাশপাতির প্রায় ২০ রকম আবাদি জাত বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান উৎপাদক দেশ চীন ও জাপান।

নাশপাতি একটি সম্ভাবনাময় বিদেশি ফল। তবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে অতি সীমিত আকারে নাশপাতির চাষ শুরু হয়েছে। নাশপাতি চাষ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি নতুন জাত প্রচলন করেছে।

আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশপাতি ভাল জন্মে। এখানে যেটা জন্মে সেটা কিছুটা লম্বাটে, ধূসর থেকে বাদামি ও কালচে বর্ণের। পাকলে হালকা কপি বর্ণের হয়। সিলেট এলাকায় যে জাতটির চাষ হয় তা অনেকটা বুনো ধরনের।

মাটি ও আবহাওয়া:নাশপাতি শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল হলেও নতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এর সফল উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় আবহাওয়া নাশপাতি চাষের অনুকূলে। সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে নাশপাতি চাষ করা যায়।

বংশ বিস্তার: সাধারণত কুড়ি সংযোজনের মাধ্যমে নাশপাতির বংশ বিস্তার করা যায়। তবে গুটি বিস্তার পদ্ধতিতে ও চাষাবাদ করা যায়। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে কলম বাঁধা হয়। কলম তৈরির জন্য লেবু লিচু ইত্যাদির মত উপাদান ব্যবহার করা যায়। জুলাই-আগষ্টে কলম কাটার উপযোগী সময়।

চারা রোপণ ও সার প্রয়োগ: সাধারণত বর্ষাকালে চারা কলম রোপণ করা হয়। মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যনত্দ চারা রোপণ করা যায়। রোপণ দূরত্ব হবে ৪ থেকে ৬ মিটার। বসতবাড়ির আশপাশের ঢালু জমিতেও চারা রোপণ করা যায়। পাহাড়ের ঢালে নির্দিষ্ট দূরত্বে নাশপাতির চাষ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। ৬০ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার গভীর ও চওড়া গর্তের মাটির সঙ্গে পচা গোবর ১৫ থেকে ২০ কেজি, খৈল ১ কেজি, টিএসপি ৫০০ গ্রাম এবং এমপি ২৫০ গ্রাম। সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে উপাদানগুলো পচাতে হবে। নাশপাতি গাছে নাইট্রোজেন সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তাই গাছ লাগানোর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী গাছে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। বয়স্ক ও ফলনত্দ গাছে বর্ষা মৌসুমের আগে এবং পরে মধ্য জ্যৈষ্ঠ এবং আশ্বিনের শেষে পচা গোবর ৩০ কেজি, খৈল ২ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, এবং টিএসপি ৪০০ গ্রাম দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে অনত্দত ১ মিটার দূরত্বে বৃত্তাকারে ২৫ সেন্টিমিটার গভীর ও চওড়া নালা করে উত্তোলিত মাটির সঙ্গে যাবতীয় সার ভালভাবে মিশিয়ে নালা ভরাট করে দিতে হবে।

রোগ ও পোকামাকড়: নাশপাতির বিভিন্ন রোগের মধ্যে কাণ্ডের কালো ফাঙ্গাস রোগই প্রধান। যে কোন বয়সের ডালে এ রোগ হতে পারে। প্রতিকারের জন্য, আক্রানত্দ শাখা ছেটে দিতে হবে এবং ক্ষতস্থানে বোর্দোপেষ্ট লাগাতে হবে। এছাড়া পুরানো কাণ্ডে কালো ব্যান্ড হয়, যা পার্বত্য এলাকার নাশপাতির একটি প্রধান রোগ। নাশপাতিতে কাণ্ডছিদ্রকারী পোকা ও উঁই পোকার আক্রমণ বেশি। কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকাগুলোর শুটকীট কাণ্ড ছিদ্র করে। ফলে আক্রানত্দ ডাল শুকিয়ে মরে যায়।

ফল সংগ্রহ ও ফলন: কলমের গাছে রোপণের ২ থেকে ৩ বছর পর থেকেই ফল দেয়া শুরু করে। মার্চ-এপ্রিলে ফুল আসে এবং জুলাই আগষ্ট মাসে ফল পরিপক্ক হয়। ফল ধারণ গাছের বয়স ও বাড়নত্দের ওপর নির্ভর করে। বয়স্ক গাছে বার্ষিক গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টির মত ফল ধরে।

নাশপাতি একটি পুষ্টিকর ফল। এর চাষ বাড়ানোর জন্য প্রত্যেকের উদ্যোগ নেয় দরকার।

পর্ব-২: ঢালু জমিতে নাশপাতি চাষ

নাশপাতি শীতকালীন অঞ্চলের ফল হলেও আমাদের দেশে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় নাশপাতি ফল উৎপাদন সম্ভব। পাহাড়ি ঢালু জায়গায় কিংবা বসতবাড়ির ঢালু জমিতেও নাশপাতির চাষ করা যায়। কীভাবে নাশপাতি চাষ করতে হবে আসুন তা আমরা জেনে নেই।

মাটি: সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে নাশপাতি চাষ করা যায়। চট্টগ্রামের কিছু কিছু অঞ্চলে (পাহাড়ের ঢালে) নাশপাতির চাষ শুরু হয়েছে। নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর পাহাড়ি অঞ্চলও নাশপাতি চাষের অনুকূলে।

বংশবিস্তার: কুঁড়ি সংযোজনের মাধ্যমে সাধারণত নাশপাতি বংশবিস্তার হয়ে থাকে।

সময় কাল: এপ্রিল-মে মাসে নাশপাতির কলম বাঁধতে হয়। এরপর জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে কলম কেটে রোপণ করতে হয়। এই সময়টাকেই রোপণের উপযুক্ত সময়।

চারা রোপণ: মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর (বর্ষাকাল) পাহাড়ের ঢালু স্থানে বা বসতবাড়ির আশপাশের ঢালু জায়গাতে চারা বা কলম রোপণ করতে হয়।

রোপণের দূরত্ব: নাশপাতি চাষের জন্য ৪ থেকে ৬ মিটার দূরত্বে গাছ লাগাতে হবে।

সার প্রয়োগ: নাশপাতি গাছে সাধারণত জৈবসার ব্যবহার করই ভাল। এছাড়া পচা গোবর- ১৫ থেকে ২০ কেজি, খৈল-১ কেজি, টিএসপি- ৫০০ গ্রাম, এমপি-২৫০ গ্রাম।

সার প্রয়োগ কৌশল: ১ মিটার গভীর ও চওড়া গর্তের মাটির সঙ্গে সারগুলো ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে উপাদানগুলো পচাতে হবে। চারা লাগানোর ১ মাস থেকে দেড় মাস পর প্রতি গাছে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করলে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

রোগ ও পোকামাকড়: ফাংগাস রোগই নাশপাতির প্রধান রোগ। এছাড়া কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা নাশপাতি গাছের কাণ্ড ছিদ্র করে ফেলে। আক্রান- ডাল শুকিয়ে মারা যায়।

রোগ দমন কৌশল: যে গাছ আক্রান- হবে সে গাছের জন্য করণীয় :
১. আক্রান- ডাল ছেটে দিতে হবে।
২. ক্ষত স্থানে বোর্দোপেষ্ট লাগাতে হবে এবং সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে।

নাশপাতি ফল সংগ্রহ: সাধারণত রোপণের ২ থেকে ৩ বছর পর নাশপাতি গাছে ফল ধরে।

ফলন: বয়স্ক গাছে প্রতি বছর গড়ে ১৫০ থেকে ২৫০টি নাশপাতি ফল ধরে।

আসুন আমরা পাহাড়ের ঢালে, পাশাপাশি বসতবাড়ির ঢালু স্থানে নাশপাতি গাছ লাগাই।
এগ্রোবাংলা ডটকম

পর্ব-৩: উঁচু ও ঢালু জমিতে নাশপাতি ফলানো সম্ভব

নাশপাতি

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রতি কেজি নাশপাতি ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। অন্য ফলের তুলনায় বাজার মূল্য এবং ফলন অধিক হওয়ায় নাশপাতি চাষ খুবই লাভজনক। বিদেশি ফলের ওপর নির্ভরতা কমানো, মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়, অধিক কর্মসংস্থান এবং লাভজনক ফল উত্পাদনে আগ্রহী উদ্যোক্তারা নাশপাতি চাষে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছি। নাশপাতি চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং সিলেটের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, হর্টিকালচার সেন্টার কিংবা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে যোগাযোগ করা যাবে।

বাংলায় নাশপাতি নামে পরিচিত ভিন দেশী এ ফলটি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। নাশপাতির রং সবুজ, আপেলের চেয়ে কিছুটা লম্বা, আকারে বড় এবং অধিক রসালো। বাংলাদেশে বর্তমানে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে নাশপাতির চাষ হচ্ছে। তবে দেশের অন্যান্য স্থানের যে কোনো উঁচু ও ঢালু জমিতেই এর চাষ করা সম্ভব।

পুষ্টিগুণ : ফল হিসেবে নাশপাতি একটি উচ্চমানের পুষ্টগুণসম্পন্ন। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’। প্রতি ১০০ গ্রাম নাশপাতিতে শ্বেতসার ১১.৪০, প্রোটিন ০.২, চর্বি ০.১, ভিটামিন ‘এ’ ০.১৪ আইইউ, ভিটমিন ‘বি’ ২.২০% মি.গ্রাম, লৌহ ০.০১ ও ফসফরাস ০.০৭ শতাংশ রয়েছে।

জাত : পৃথিবীতে নাশপাতির অনেক জাত রয়েছে। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বারি নাশপাতি-১ জাতের চাষই অধিক উপযোগী বলে গৃহীত হয়েছে।

উত্পাদন প্রক্রিয়া : জলবায়ু ও মাটির গুণাগুণের ওপর নাশপাতি উত্পাদন নির্ভরশীল। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন ঢালু জমি নাশপাতি চাষের জন্য অধিক উপযোগী। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রয়োজন হয়, তবে তাপমাত্রা ৪২হ্ন সে.এর অধিক এর জন্য ক্ষতিকর। গ্রীষ্মকালে জমিতে সেচ দিতে হয়। সাধারণত গুটিকলমের মাধ্যমে নাশপাতির বংশবিস্তার করা হয়। চট্টগ্রাাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এবং হর্টিকালচার সেন্টারে নাশপাতির চারা পাওয়া যায়।

জমি তৈরি : নামপাতি চাষের জন্য আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হয়। চারা রোপণের জন্য ২ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও ২ ফুট গভীর গর্ত প্রস্তুত করতে হবে। এ গর্তে ১০-১৫ কেজি পচা গোবর সার কিংবা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ২৫০ গ্রাম সুপার ফসফেট, ২৫০ গ্রাম পটাশ মিশ্রিত করে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। সব সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশানোর পর ৭ থেকে ১০ দিন রেখে দিতে হবে। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস (মে থেকে আগস্ট) চারা রোপণের জন্য উত্তম সময়। জমিতে ১০ ফুট অন্তর অন্তর চারা রোপণ করতে হয়।

পরিচর্যা : নাশপাতি গাছের অঙ্গ ছাঁটাই অত্যাবশ্যক। ছাঁটাই না করলে ডালপালার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় না এবং ডালগুলো সরু ও লম্বা হয়ে উপরের দিকে বেড়ে যায়। এতে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। গাছের উচ্চতা ২-৩ হওয়ার পর প্রথম অঙ্গ ছাঁটাই বা ডগা কেটে ফেলতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে গাছের গোড়ায় ২-৩ দিন পর পর সেচ দিতে হয়। এতে গাছের বৃদ্ধি হয় এবং ফলন বাড়ে।

পোকামাকড় : এক ধরনের পোকা কচি নাশপাতি ছিদ্র করে তার ভেতরে প্রবেশ করে। এর ফলে নাশপাতি নষ্ট হয়ে যায়। নাশপাতিতে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করলে পোকার আক্রমণ থেকে নাশপাতি রক্ষা পায়। এছাড়া কাঠবিড়ালী এবং কোনো কোনো প্রজাতির পাখি নাশপাতি খেয়ে থাকে। এগুলো থেকে নাশপাতির বাগান করার জন্য টিনের সঙ্গে লাঠি বেঁধে দড়ি দ্বারা টেনে উচ্চশব্দ তৈরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
লেখক : মো. আলী আশরাফ খান, গবেষক, গ্রন্থাকার ও প্রধান নিরীক্ষা কর্মকর্তা, বিসিক, ঢাকা

এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।